ও তাহার পারিষদবর্গ
রানীবেশে ক্ষীরো
ও তাহার পারিষদবর্গ
ক্ষীরো।
বিনি!
বিনি।
কেন মাসি।
ক্ষীরো।
মাসি কী রে মেয়ে!
দেখি নি তো আমি বোকা তোর চেয়ে।
কাঙাল ভিখিরি কলু মালী চাষি
তারাই মাসিরে বলে শুধু মাসি।
রানীর বোনঝি হয়েছ ভাগ্যে,
জান না আদব! মালতী!
মালতী।
আজ্ঞে।
ক্ষীরো।
রানীর বোনঝি রানীরে কী ডাকে
শিখিয়ে দে ওই বোকা মেয়েটাকে।
মালতী।
ছি ছি, শুধু মাসি বলে কি রানীকে?
রানীমাসি বলে রেখে দিয়ো শিখে।
ক্ষীরো।
মনে থাকবে তো? কোথা গেল কাশী।
কাশী।
কেন রানীদিদি।
ক্ষীরো।
চার-চার দাসী
নেই যে সঙ্গে?
কাশী।
এত লোক মিছে
কেন দিনরাত লেগে থাকে পিছে?
ক্ষীরো।
মালতী!
মালতী।
আজ্ঞে।
ক্ষীরো।
এই মেয়েটাকে
শিখিয়ে দে কেন এত দাসী থাকে।
মালতী।
তোমরা তো নও জেলেনী তাঁতিনী,
তোমরা হও যে রানীর নাতিনী।
যে নবাববাড়ি এনু আমি ত্যেজি
সেথা বেগমের ছিল পোষা বেজি,
তাহারি একটা ছোটো বাচ্ছার
পিছনেতে ছিল দাসী চার-চার,
তা ছাড়া সেপাই।
ক্ষীরো।
শুনলি তো কাশী?
কাশী।
শুনেছি।
ক্ষীরো।
তা হলে ডাক্ তোর দাসী।
কিনি পোড়ামুখী!
কিনি।
কেন রানীখুড়ি?
ক্ষীরো।
হাই তুললেম, দিলি নে যে তুড়ি!
মালতী!
মালতী।
আজ্ঞে।
ক্ষীরো।
শেখাও কায়দা।
মালতী।
এত বলি তবু হয় না ফায়দা।
বেগমসাহেব যখন হাঁচেন
তুড়ি ভুল হলে কেহ না বাঁচেন।
তখনি শূলেতে চড়িয়ে তারে
নাকে কাঠি দিয়ে হাঁচিয়ে মারে।
ক্ষীরো।
সোনার বাটায় পান দে তারিণী।
কোথা গেল মোর চামরধারিণী?
তারিণী।
চলে গেছে ছুঁড়ি, সে বলে মাইনে
চেয়ে চেয়ে তবু কিছুতে পাই নে।
ক্ষীরো।
ছোটোলোক বেটী হারামজাদী
রানীর ঘরে সে হয়েছে বাঁদি,
তবু মনে তার নেই সন্তোষ--
মাইনে পায় না ব'লে দেয় দোষ!
পিঁপড়ের পাখা কেবল মরতে।
মালতী!
মালতী।
আজ্ঞে।
ক্ষীরো।
মাগীরে ধরতে
পাঠাও আমার ছ-ছয় পেয়াদা,
না না, যাবে আরো দুজন জেয়াদা।
কী বল মালতী।
মালতী।
দস্তুর তাই।
ক্ষীরো।
হাতকড়ি দিয়ে বেঁধে আনা চাই।
তারিণী।
ও পাড়ার মতি রানীমাতাজির
চরণ দেখতে হয়েছে হাজির।
ক্ষীরো।
মালতী!
মালতী।
আজ্ঞে।
ক্ষীরো।
নবাবের ঘরে
কোন্ কায়দায় লোকে দেখা করে?
মালতী।
কুর্নিস ক'রে ঢোকে মাথা নুয়ে,
পিছু হটে যায় মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
ক্ষীরো।
নিয়ে এসে সাথে, যাও তো মালতী,
কুর্নিস করে আসে যেন মতি।
মতিকে লইয়া মালতীর পুনঃপ্রবেশ
মালতী।
মাথা নিচু করো। মাটি ছোঁও হাতে,
লাগাও হাতটা নাকের ডগাতে।
তিন পা এগোও, নিচু করো মাথা।
মতি।
আর তো পারি নে, ঘাড়ে হল ব্যথা।
মালতী।
তিন বার নাকে লাগাও হাতটা।
মতি।
টন্ টন্ করে পিঠের বাতটা।
মালতী।
তিন পা এগোও, তিন বার ফের্
ধুলো তুলে নেও ডগায় নাকের।
মতি।
ঘাট হয়েছিল এসেছি এ পথ,
এর চেয়ে সিধে নাকে দেওয়া খত।
জয় রানীমার, একাদশী আজি।
ক্ষীরো।
রানীর জ্যোতিষী শুনিয়েছে পাঁজি।
কবে একাদশী, কবে কোন্ বার
লোক আছে মোর তিথি গোনবার।
মতি।
টাকাটা সিকেটা যদি কিছু পাই
জয় জয় বলে বাড়ি চলে যাই।
ক্ষীরো।
যদি না'ই পাও তবু যেতে হবে--
কুর্নিস করে চলে যাও তবে।
মতি।
ঘড়া ঘড়া টাকা ঘরে গড়াগড়ি,
তবু কড়াকড় দিতে কড়াকড়ি!
ক্ষীরো।
ঘরের জিনিস ঘরেরই ঘড়ায়
চিরদিন যেন ঘরেই গড়ায়।
মালতী!
মালতী।
আজ্ঞে।
ক্ষীরো।
এবার মাগীরে
কুর্নিস করে নিয়ে যাও ফিরে।
মতি।
চললেম তবে।
মালতী।
রোসো, ফিরো নাকো,
তিন বার মাটি তুলে নাকে মাখো।
তিন পা কেবল হটে যাও পিছু,
পোড়ো না উল্টে মাথা করো নিচু।
মতি।
হায়, কোথা এনু, ভরল না পেট--
বারে বারে শুধু মাথা হল হেঁট।
আহা, কল্যাণী রানীর ঘরে
কর্ণ জুড়োয় মধুর স্বরে--
কড়ি যদি দেন অমূল্য তাই--
হেথা হীরে মোতি সেও অতি ছাই।
ক্ষীরো।
সে ছাই পাবার ভরসা কোরো না।
মালতী।
সাবধানে হঠো, উল্টে পোড়ো না।
[মতির প্রস্থান
[মতির প্রস্থান
ক্ষীরো।
বিনি!
বিনি।
রানীমাসি!
ক্ষীরো।
একগাছি চুড়ি
হাত থেকে তোর গেছে না কি চুরি।
বিনি।
চুরি তো যায় নি।
ক্ষীরো।
গিয়েছে হারিয়ে?
বিনি।
হারায় নি।
ক্ষীরো।
কেউ নিয়েছে ভাঁড়িয়ে?
বিনি।
না গো রানীমাসি!
ক্ষীরো।
এটা তো মানিস
পাখা নেই তার। একটা জিনিস
হয় চুরি যায়, নয় তো হারায়,
নয় মারা যায় ঠগের দ্বারায়,
তা না হলে থাকে--এ ছাড়া তাহার
কী যে হতে পারে জানি নে তো আর।
বিনি।
দান করেছি সে!
ক্ষীরো।
দিয়েছিস দানে?
ঠকিয়েছে কেউ, তারই হল মানে।
কে নিয়েছে বল্।
বিনি।
মল্লিকা দাসী।
এমন গরিব নেই রানীমাসি!
ঘরে আছে তার সাত ছেলে মেয়ে,
মাস পাঁচ-ছয় মাইনে না পেয়ে
খরচপত্র পাঠাতে পারে না--
দিনে দিনে তার বেড়ে যায় দেনা,
কেঁদে কেঁদে মরে-- তাই চুড়িগাছি
নুকিয়ে তাহারে দান করিয়াছি।
অনেক তো চুড়ি আছে মোর হাতে,
একখানা গেলে কি হবে তাহাতে।
ক্ষীরো।
বোকা মেয়েটার শোনো ব্যাখ্যানা
একখানা গেলে গেল একখানা,
সে যে একেবারে ভারি নিশ্চয়।
কে না জানে যেটা রাখ সেটা রয়,
যেটা দিয়ে ফেল সেটা তো রয় না--
এর চেয়ে কথা সহজ হয় না।
অল্পস্বল্প যাদের আছে
দানে যশ পায় লোকের কাছে--
ধনীর দানেতে ফল নাহি ফলে,
যত দেও তত পেট বেড়ে চলে--
কিছুতে ভরে না লোকের স্বার্থ,
ভাবে "আরো ঢের দিতে যে পারত'।
অতএব বাছা, হবি সাবধান,
বেশি আছে বলে করিস নে দান।
মালতী!
মালতী।
আজ্ঞে।
ক্ষীরো।
বোকা মেয়েটি এ,
এর দুটো কথা দাও সমঝিয়ে।
মালতী।
রানীর বোনঝি রানীর অংশ,
তফাতে থাকবে উচ্চ বংশ;
দান করা-টরা যত হয় বেশি
গরিবের সাথে তত ঘেঁষাঘেঁষি।
পুরোনো শাস্ত্রে লিখেছে শোলোক,
গরিবের মতো নেই ছোটোলোক।
ক্ষীরো।
মালতী!
মালতী।
আজ্ঞে।
ক্ষীরো।
মল্লিকাটারে
আর তো রাখা না।
মালতী।
তাড়াব তাহারে।
ছেলেমেয়েদের দয়ার চর্চা
বেড়ে গেলে সাথে বাড়বে খরচা।
ক্ষীরো।
তাড়াবার বেলা হয়ে আনমনা
বালাটা-সুদ্ধ যেন তাড়িয়ো না।--
বাহিরের পথে কে বাজায় বাঁশি
দেখে আয় মোর ছয় ছয় দাসী।
তারিণীর প্রস্থান ও পুনঃপ্রবেশ
তারিণীর প্রস্থান ও পুনঃপ্রবেশ
তারিণী।
মধুদত্তর পৌত্রের বিয়ে,
ধুম করে তাই চলে পথ দিয়ে।
ক্ষীরো।
রানীর বাড়ির সামনের পথে
বাজিয়ে যাচ্ছে কী নিয়ম-মতে।
বাঁশির বাজনা রানী কি সইবে!
মাথা ধ'রে যদি থাকত দৈবে?
যদি ঘুমোতেন, কাঁচা ঘুমে জেগে
অসুখ করত যদি রেগেমেগে?
মালতী!
মালতী।
আজ্ঞে।
ক্ষীরো।
নবাবের ঘরে
এমন কাণ্ড ঘটলে কী করে।
মালতী।
যার বিয়ে যায় তারে ধরে আনে,
দুই বাঁশিওয়ালা তার দুই কানে
কেবলই বাজায় দুটো-দুটো বাঁশি;
তিন দিন পরে দেয় তারে ফাঁসি।
ক্ষীরো।
ডেকে দাও কোথা আছে সর্দার,
নিয়ে যাক দশ জুতোবর্দার--
ফি লোকের পিঠে দশ ঘা চাবুক
সপাসপ বেগে সজোরে নাবুক।
মালতী।
তবু যদি কারো চেতনা না হয়,
বন্দুক দিলে হবে নিশ্চয়।
প্রথমা।
ফাঁসি হল মাপ, বড়ো গেল বেঁচে,
জয় জয় ব'লে বাড়ি যাবে নেচে।
দ্বিতীয়া।
প্রসন্ন ছিল তাদের গ্রহ,
চাবুক ক' ঘা তো অনুগ্রহ।
তৃতীয়া।
বলিস কী ভাই, ফাঁড়া গেল কেটে--
আহা, এত দয়া রানীমার পেটে।
ক্ষীরো।
থাম তোরা, শুনে নিজ গুণগান
লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে কান।
বিনি!
বিনি।
রানীমাসি!
ক্ষীরো।
স্থির হয়ে রবি,
ছট্ফট্ করা বড়ো বে-আদবি।
মালতী!
মালতী।
আজ্ঞে।
ক্ষীরো।
মেয়েরা এখনো
শেখে নি আমিরি দস্তুর কোনো।
(বিনির প্রতি)
(বিনির প্রতি)
মালতী।
রানীর ঘরের ছেলেমেয়েদের
ছট্ফট্ করা ভারি নিন্দের।
ইতর লোকেরই ছেলেমেয়েগুলো
হেসেখুশে ছুটে করে খেলাধুলো।
রাজারানীদের পুত্রকন্যে
অধীর হয় না কিছুরই জন্যে!
হাত-পা সামলে খাড়া হয়ে থাকো,
রানীর সামনে নোড়ো-চোড়ো নাকো।
ক্ষীরো।
ফের গোলমাল করছে কাহারা।
দরজায় মোর নাই কি পাহারা।
তারিণী।
প্রজারা এসেছে নালিশ করতে।
ক্ষীরো।
আর কি জায়গা ছিল না মরতে!
মালতী।
প্রজার নালিশ শুনবে রাজ্ঞী
ছোটোলোকদের এত কি ভাগ্যি!
প্রথমা।
তাই যদি হবে তবে অগণ্য
নোকর চাকর কিসের জন্য।
দ্বিতীয়া।
নিজের রাজ্যে রাখতে দৃষ্টি
রাজারানীদের হয় নি সৃষ্টি।
তারিণী।
প্রজারা বলছে, কর্মচারী
পীড়ন তাদের করছে ভারি।
নাই মায়া দয়া, নাইকো ধর্ম,
বেচে নিতে চায় গায়ের চর্ম।
বলে তারা, "হায় কী করেছি পাপ,
এত ছোটো মোরা, এত বড়ো চাপ!'
ক্ষীরো।
সর্ষেও ছোটো তবু সে ভোগায়,
চাপ না পেলে কি তৈল জোগায়।
টাকা জিনিসটা নয় পাকা ফল,
টুপ করে খ'সে ভরে না আঁচল,
ছিঁড়ে নাড়া দিয়ে ঠেঙার বাড়িতে
তবে ও জিনিস হয় যে পাড়িতে।
তারিণী।
সেজন্যে না মা--তোমার খাজনা
বঞ্চনা করা তাদের কাজ না।
তারা বলে, যত আমলা তোমার
মাইনে না পেয়ে হয়েছে গোঁয়ার।
লুটপাট করে মারছে প্রজা,
মাইনে পেলেই থাকবে সোজা।
ক্ষীরো।
রানী বটি, তবু নইকো বোকা,
পারবে না দিতে মিথ্যে ধোঁকা।
করবেই তারা দস্যুবৃত্তি,
মাইনেটা দেওয়া মিথ্যেমিথ্যি।
প্রজাদের ঘরে ডাকাতি করে,
তা বলে করবে রানীরও ঘরে?
তারিণী।
তারা বলে রানী কল্যাণী যে
নিজের রাজ্য দেখেন নিজে।
নালিশ শোনেন নিজের কানেই,
প্রজাদের 'পরে জুলুমটা নেই।
ক্ষীরো।
ছোটোমুখে বলে বড়ো কথাগুলা,
আমার সঙ্গে অন্যের তুলা?
মালতী?
মালতী।
আজ্ঞে।
ক্ষীরো।
কী কর্তব্য।
মালতী।
জরিমানা দিক যত অসভ্য
এক-শো এক-শো।
ক্ষীরো।
গরিব ওরা যে,
তাই একেবারে এক-শো'র মাঝে
নব্বই টাকা করে দিনু মাপ।
প্রথমা।
আহা, গরিবের তুমিই মা বাপ।
দ্বিতীয়া।
কার মুখ দেখে উঠেছিল প্রাতে,
নব্বই টাকা পেল হাতে হাতে।
তৃতীয়া।
নব্বই কেন, যদি ভেবে দেখে--
আরো ঢের টাকা নিয়ে গেল ট্যাঁকে।
হাজার টাকার ন-শো নব্বই
চোখের পলকে পেল সর্বই।
চতুর্থী।
এক দমে ভাই এত দিয়ে ফেলা
অন্যে কে পারে, এ তো নয় খেলা।
ক্ষীরো।
বলিস নে আর মুখের আগে,
নিজগুণ শুনে শরম লাগে।
বিনি।
বিনি।
রানীমাসী!
ক্ষীরো।
হঠাৎ কী হল।
ফোঁস ফোঁস করে কাঁদিস কেন লো।
দিনরাত আমি বকে বকে খুন,
শিখলি নে কিছু কায়দা কানুন?
মালতী!
মালতী।
আজ্ঞে।
ক্ষীরো।
এই মেয়েটাকে
শিক্ষা না দিলে মান নাহি থাকে।
মালতী।
রানীর বোনঝি জগতে মান্য,
বোঝ না এ কথা অতি সামান্য।
সাধারণ যত ইতর লোকেই
সুখে হাসে, কাঁদে দুঃখশোকেই।
তোমাদেরও যদি তেমনি হবে,
বড়োলোক হয়ে হল কী তবে।
একজন দাসীর প্রবেশ
দাসী।
মাইনে না পেলে মিথ্যে চাকরি।
বাঁধা দিয়ে এনু কানের মাকড়ি--
ধার করে খেয়ে পরের গোলামি
এমন কখনো শুনি নি তো আমি।
মাইনে চুকিয়ে দাও, তা না হলে
ছুটি দাও আমি ঘরে যাই চলে।
ক্ষীরো।
মাইনে চুকোনো নয়কো মন্দ,
তবু ছুটিটাই মোর পছন্দ।
বড়ো ঝঞ্ঝাট মাইনে বাঁটতে,
হিসেব-কিতেব হয় যে ঘাঁটতে।
ছুটি দেওয়া যায় অতি সত্বর,
খুলতে হয় না খাতাপত্তর--
ছ-ছয় পেয়াদা ধরে আসি কেশ,
নিমেষ ফেলতে কর্ম নিকেশ।
মালতী!
মালতী।
আজ্ঞে।
ক্ষীরো।
সাথে যাও ওর,
ঝেড়ে ঝুড়ে নিয়ো কাপড়চোপড়--
ছুটি দেয় যেন দরোয়ান যত
হিন্দুস্থানি দস্তুর-মত।
মালতী।
বুঝেছি রানীজি!
ক্ষীরো।
আচ্ছা, তা হলে
কুর্নিস করে যাক বেটি চলে।
[কুর্নিস করাইয়া দাসীকে বিদায়
[কুর্নিস করাইয়া দাসীকে বিদায়
দাসী।
দুয়ারে রানীমা দাঁড়িয়ে আছে কে,
বড়োলোকের ঝি মনে হয় দেখে।
ক্ষীরো।
এসেছে কি হাতি কিম্বা রথে?
দাসী।
মনে হয় যেন হেঁটে এল পথে।
ক্ষীরো।
কোথা তবে তার বড়োলোকত্ব?
দাসী।
রানীর মতন মুখটি সত্য।
ক্ষীরো।
মুখে বড়োলোক লেখা নাহি থাকে,
গাড়িঘোড়া দেখে চেনা যায় তাকে।
মালতীর প্রবেশ
মালতীর প্রবেশ
মালতী।
রানী কল্যাণী এসেছেন দ্বারে
রানীজির সাথে দেখা করিবারে।
ক্ষীরো।
হেঁটে এসেছেন?
মালতী।
শুনছি তাই তো।
ক্ষীরো।
তা হলে হেথায় উপায় নাই তো।
সমান আসন কে তাহারে দেয়।
নিচু আসনটা, সে'ও অন্যায়।
এ এক বিষম হল সমিস্যে,
মীমাংসা এর কে করে বিশ্বে?
প্রথমা।
মাঝখানে রেখে রানীজির গদি
তাহার আসন দূরে রাখি যদি?
দ্বিতীয়া।
ঘুরায়ে যদি এ আসনখানি
পিছন ফিরিয়া বসেন রানী?
তৃতীয়া।
যদি বলা যায় "ফিরে যাও আজ--
ভালো নেই আজ রানীর মেজাজ'?
ক্ষীরো।
মালতী!
মালতী।
আজ্ঞে।
ক্ষীরো।
কী করি উপায়।
মালতী।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যদি সারা যায়
দেখাশোনা, তবে সব গোল মেটে।
ক্ষীরো।
এত বুদ্ধিও আছে তোর পেটে।
সেই ভালো। আগে দাঁড়া সার বাঁধি
আমার এক-শো পঁচিশটে বাঁদি।
ও হল না ঠিক--পাঁচ পাঁচ করে
দাঁড়া ভাগে ভাগে-- তোরা আয় সরে--
না না, এই দিকে-- না না, কাজ নেই,
সারি সারি তোরা দাঁড়া সামনেই--
না না, তা হলে যে মুখ যাবে ঢেকে।
কোনাকুনি তোরা দাঁড়া দেখি বেঁকে।
আচ্ছা, তা হলে ধরে হাতে হাতে
খাড়া থাক্ তোরা একটু তফাতে।
শশী, তুই সাজ্ ছত্রধারিণী,
চামরটা নিয়ে দোলাও তারিণী।
মালতী!
মালতী।
আজ্ঞে।
ক্ষীরো।
এইবার তারে
ডেকে নিয়ে আয় মোর দরবারে।
[মালতীর প্রস্থান
কিনি বিনি কাশী স্থির হয়ে থাকো--
খবর্দার, কেউ নোড়ো-চোড়ো নাকো।
মোর দুই পাশে দাঁড়াও সকলে
দুই ভাগ করি।
কল্যাণী ও মালতীর প্রবেশ
কল্যাণী ও মালতীর প্রবেশ
কল্যাণী।
আছ তো কুশলে?
ক্ষীরো।
আমার চেষ্টা কুশলেই থাকি,
পরের চেষ্টা দেবে মোরে ফাঁকি,
এই ভাবে চলে জগৎ-সুদ্ধ
নিজের সঙ্গে পরের যুদ্ধ।
কল্যাণী।
ভালো আছ বিনি?
বিনি।
ভালোই আছি মা,
ম্লান কেন দেখি সোনার প্রতিমা!
ক্ষীরো।
বিনি, করিস নে মিছে গোলযোগ,
ঘুচল না তোর কথা-কওয়া রোগ?
কল্যাণী।
রানী, যদি কিছু না কর মনে,
কথা আছে কিছু-- কব গোপনে।
ক্ষীরো।
আর কোথা যাব, গোপন এই তো--
তুমি আমি ছাড়া কেহই নেই তো।
এরা সব দাসী, কাজ নেই কিছু--
রানীর সঙ্গে ফেরে পিছু-পিছু।
হেথা হতে যদি করে দিই দূর
হবে না তো সেটা ঠিক দস্তুর;
কী বল মালতী!
মালতী।
আজ্ঞে, তাই তো,
দস্তুরমত চলাই চাই তো।
ক্ষীরো।
সোনার বাটাটা কোথায় কে জানে।
খুঁজে দেখ্ দেখি।
দাসী।
এই-যে এখানে।
ক্ষীরো।
ওটা নয়, সেই মুক্তো-বসানো
আরেকটা আছে সেইটেই আনো।
[অন্য বাটা-অনয়ন
খয়েরের দাগ লেগেছে ডালায়,
বাঁচি নে তো আর তোদের জ্বালায়।
তবে নিয়ে আয় চুনীর সে বাটা--
না না, নিয়ে আয় পান্না-দেওয়াটা।
কল্যাণী।
কথাটা আমার নিই তবে বলে।
পাঠান বাদশা অন্যায় ছলে
রাজ্য আমার নিয়েছেন কেড়ে--
ক্ষীরো।
বল কী! তা হলে গেছে ফুলবেড়ে,
গিরিধরপুর, গোপালনগর
কানাইগঞ্জ--
কল্যাণী।
সব গেছে মোর।
ক্ষীরো।
হাতে আছে কিছু নগদ টাকা কি।
কল্যাণী।
সব নিয়ে গেছে, কিছু নেই বাকি।
ক্ষীরো।
অদৃষ্টে ছিল এত দুখ তোর!
গয়না যা ছিল হীরে মুক্তোর,
সেই বড়ো বড়ো নীলার কণ্ঠি,
কানবালা জোড়া বেড়ে গড়নটি,
সেই-যে চুনীর পাঁচনলি হার,
হীরে-দেওয়া সিঁথি লক্ষ টাকার--
সেগুলো নিয়েছে বুঝি লুটেপুটে?
কল্যাণী।
সব নিয়ে গেছে সৈন্যেরা জুটে।
ক্ষীরো।
আহা, তাই বলে, ধনজনমান
পদ্মপত্রে জলের সমান।
দামি তৈজস ছিল যা পুরোনো
চিহ্নও তার নেই বুঝি কোনো?
সেকালের সব জিনিসপত্র
আসাসোটাগুলো চামরছত্র
চাঁদোয়া কানাত-- গেছে বুঝি সব?
শাস্ত্রে যে বলে ধনবৈভব
তড়িৎ সমান, মিথ্যে সে নয়।
এখন তা হলে কোথা থাকা হয়।
বাড়িটা তো আছে?
কল্যাণী।
ফৌজের দল
প্রাসাদ আমার করেছে দখল।
ক্ষীরো।
ওমা, ঠিক এ যে শোনায় কাহিনী--
কাল ছিল রানী, আজ ভিখারিনি।
শাস্ত্রে তাই তো বলে সব মায়া,
ধনজন তালবৃক্ষের ছায়া।
কী বল মালতী!
মালতী।
তাই তো বটেই,
বেশি বাড় হলে পতন ঘটেই।
কল্যাণী।
কিছু দিন যদি হেথায় তোমার
আশ্রয় পাই, করি উদ্ধার
আবার আমার রাজ্যখানি_
অন্য উপায় নাহিকো জানি।
ক্ষীরো।
আহা, তুমি রবে আমার হেথায়
এ তো বেশ কথা, সুখেরই কথা এ।
প্রথমা।
আহা, কত দয়া!
দ্বিতীয়া।
মায়ার শরীর!
তৃতীয়া।
আহা, দেবী তুমি, নও পৃথিবীর।
চতুর্থী।
হেথা ফেরে নাকো অধম পতিত,
আশ্রয় পায় অনাথ অতিথ।
ক্ষীরো।
কিন্তু একটা কথা আছে বোন!
বড়ো বটে মোর প্রাসাদভবন,
তেমনি যে ঢের লোকজন বেশি--
কোনোমতে তারা আছে ঠেসাঠেসি।
এখানে তোমার জায়গা হবে না
সে একটা মহা রয়েছে ভাবনা।
তবে কিছু দিন যদি ঘর ছেড়ে
বাইরে কোথাও থাকি তাঁবু গেড়ে--
প্রথমা।
ওমা, সে কী কথা!
দ্বিতীয়া।
তা হলে রানীমা,
রবে না তোমার কষ্টের সীমা।
তৃতীয়া।
যে-সে তাঁবু নয়, তবু সে তাঁবুই,
ঘর থাকতে কি ভিজবে বাবুই!
পঞ্চমী।
দয়া করে কত নাববে নাবোতে,
রানী হয়ে কি না থাকবে তাঁবুতে!
ষষ্ঠী।
তোমার সে দশা দেখলে চক্ষে
অধীনগণের বাজবে বক্ষে।
কল্যাণী।
কাজ নেই রানী, সে অসুবিধায়--
আজকের তরে লইনু বিদায়।
ক্ষীরো।
যাবে নিতান্ত? কী করব ভাই!
ছুঁচ ফেলবার জায়গাটি নাই।
জিনিসপত্র লোক-লশকরে
ঠাসা আছে ঘর--কারে ফস করে
বসতে বলি যে তার জোটি নেই।
ভালো কথা, শোনো, বলি গোপনেই,
গয়নাপত্র কৌশলে রাতে
দু-দশটা যাহা পেরেছ সরাতে
মোর কাছে দিলে রবে যতনেই।
কল্যাণী।
কিছুই আনি নি, শুধু হেরো এই
হাতে দুটি চুড়ি, পায়েতে নূপুর।
ক্ষীরো।
আজ এস তবে, বেজেছে দুপুর--
শরীর ভালো না, তাইতে সকালে
মাথা ধরে যায় অধিক বকালে।
মালতী!
মালতী।
আজ্ঞে।
ক্ষীরো।
জানে না কানাই
স্নানের সময় বাজবে সানাই?
মালতী।
বেটারে উচিত করব শাসন।
[কল্যাণীর প্রস্থান
[কল্যাণীর প্রস্থান
ক্ষীরো।
তুলে রাখো মোর রত্ন-আসন--
আজকের মতো হল দরবার।
মালতী!
মালতী।
আজ্ঞে।
ক্ষীরো।
নাম করবার
সুখ তো দেখলি?
মালতী।
হেসে নাহি বাঁচি--
ব্যাঙ থেকে কেঁচে হলেন ব্যাঙাচি।
ক্ষীরো।
আমি দেখো বাছা, নাম-করাকরি,
যেখানে সেখানে টাকা-ছড়াছড়ি
জড়ো করে দল ইতর লোকের
জাঁক-জমকের লোক-চমকের
যত রকমের ভণ্ডামি আছে
ঘেঁষি নে কখনো ভুলে তার কাছে।
প্রথমা।
রানীর বুদ্ধি যেমন সারালো,
তেমনি ক্ষুরের মতন ধারালো।
দ্বিতীয়া।
অনেক মূর্খে করে দান ধ্যান,
কার আছে হেন কাণ্ডজ্ঞান।
তৃতীয়া।
রানীর চক্ষে ধুলো দিয়ে যাবে
হেন লোক হেন ধুলো কোথা পাবে!
ক্ষীরো।
থাম্ থাম্ তোরা, রেখে যে বকুনি,
লজ্জা করে যে নিজগুণ শুনি।
মালতী!
মালতী।
আজ্ঞে।
ক্ষীরো।
ওদের গয়না
ছিল যা এমন কাহারো হয় না।
দুখানি চুড়িতে ঠেকেছে শেষে,
দেখে আমি আর বাঁচি নে হেসে।
তবু মাথা যেন নুইতে চায় না,
ভিখ নেবে তবু কতই বায়না।
পথে বের হল পথের ভিখিরি,
ভুলতে পারে না তবু রানীগিরি।
নত হয় লোক বিপদে ঠেকলে,
পিত্তি জ্বলে যে দেমাক দেখলে।
আবার কিসের শুনি কোলাহল।
মালতী।
দুয়ারে এসেছে ভিক্ষুকদল--
আকাল পড়েছে, চালের বস্তা
মনের মতন হয় নি সস্তা,
তাইতে চেঁচিয়ে খাচ্ছে কানটা।
বেতটি পড়লে হবেন ঠাণ্ডা।
ক্ষীরো।
রানী কল্যাণী আছেন দাতা।
মোর দ্বারে কেন হস্ত পাতা।
বলে দে আমার পাঁড়েজি বেটাকে
ধরে নিয়ে যাক সকল-ক'টাকে,
দাতা কল্যাণী রানীর ঘরে
সেথায় আসুক ভিক্ষে করে।
সেখানে যা পাবে এখানে তাহার
আরো পাঁচ গুণ মিলবে আহার।
প্রথমা।
হা হা হা, কী মজা হবেই না জানি।
দ্বিতীয়া।
হাসিয়ে হাসিয়ে মারলেন রানী।
তৃতীয়া।
আমাদের রানী এতও হাসান!
চতুর্থী।
দু-চোখ চক্ষু-জলেতে ভাসান।
দাসীর প্রবেশ
দাসীর প্রবেশ
দাসী।
ঠাকরুন এক এসেছেন দ্বারে,
হুকুম পেলেই তাড়াই তাঁহারে।
ক্ষীরো।
না না ডেকে দে-না। আজ কিজন্য
মন আছে মোর বড়ো প্রসন্ন।
ঠাকুরানীর প্রবেশ
ঠাকুরানীর প্রবেশ
ঠাকুরানী।
বিপদে পড়েছি, তাই এনু চলে।
ক্ষীরো।
সে তো জানা কথা। বিপদে না প'লে
শুধু যে আমার চাঁদমুখখানি
দেখতে আস নি সেটা বেশ জানি।
ঠাকুরানী।
চুরি হয়ে গেছে ঘরেতে আমার--
ক্ষীরো।
মোর ঘরে বুঝি শোধ নেবে তার?
ঠাকুরানী।
দয়া করে যদি কিছু করো দান
এ যাত্রা তবে বেঁচে যায় প্রাণ।
ক্ষীরো।
তোমার যা-কিছু নিয়েছে অন্যে
দয়া চাও তুমি তাহার জন্যে!
আমার যা তুমি নিয়ে যাবে ঘরে
তার তরে দয়া আমায় কে করে।
ঠাকুরানী।
ধনসুখ আছে যার ভাণ্ডারে
দানসুখে তার সুখ আরো বাড়ে।
গ্রহণ যে করে তারি হেঁট মুখ,
দুঃখের পর ভিক্ষার দুখ।
তুমি সক্ষম, আমি নিরুপায়,
অনায়াসে পার ঠেলিবারে পায়।
ইচ্ছা না হয় না'ই কোরো দান,
অপমানিতেরে কেন অপমান!
চলিলাম তবে, বলো দয়া ক'রে
বাসনা পুরিবে গেলে কার ঘরে।
ক্ষীরো।
রানী কল্যাণী নাম শোন নাই?
দাতা বলে তাঁর বড়ো যে বড়াই।
এইবার তুমি যাও তাঁরি ঘরে
ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে এসো ভরে,
পথ না জান তো মোর লোকজন
পৌঁছিয়ে দেবে রানীর ভবন।
ঠাকুরানী।
তবে তথাস্তু। যাই তাঁরি কাছে।
তাঁর ঘর মোর খুব জানা আছে।
আমি সে লক্ষ্মী, তোর ঘরে এসে
অপমান পেয়ে ফিরিলাম শেষে।
এই কথা ক'টি করিয়ো স্মরণ--
ধনে মানুষের বাড়ে নাকো মন।
আছে বহু ধনী, আছে বহু মানী--
সবাই হয় না রানী কল্যাণী।
ক্ষীরো।
যাবে যদি তবে ছেড়ে যাও মোরে।
দস্তুরমত কুর্নিস করে।
মালতী! মালতী! কোথায় তারিণী!
কোথা গেল মোর চামরধারিণী!
আমার এক-শো পঁচিশটে দাসী?
তোরা কোথা গেলি বিনি কিনি কাশী!
কল্যাণীর প্রবেশ
কল্যাণীর প্রবেশ
কল্যাণী।
পাগল হলি কি। হয়েছে কী তোর।
এখনো যে রাত হয় নিকো ভোর--
বল্ দেখি কী যে কাণ্ড কল্লি।
ডাকাডাকি করে জাগালি পল্লী!
ক্ষীরো।
ওমা, তাই তো গা! কী জানি কেমন
সারা রাত ধরে দেখেছি স্বপন।
বড়ো কুস্বপ্ন দিয়েছিল বিধি,
স্বপনটা ভেঙে বাঁচলেম দিদি!
একটু দাঁড়াও, পদধূলি লব--
তুমি রানী, আমি চিরদাসী তব।
২৯ অগ্রহায়ণ, ১৩০৪