এ দিকে অনতিপূর্বে ভারতবর্ষের প্রতিবেশে বহুতর খণ্ডবিচ্ছিন্ন জাতি মহাপুরুষ মহম্মদের প্রচণ্ড আকর্ষণবলে একীভূত হইয়া মুসলমান নামক এক বিরাট কলেবর ধারণ করিয়া উত্থিত হইয়াছিল। তাহার যেন ভিন্ন ভিন্ন দুর্গম মরুময় গিরিশিখরের উপরে খণ্ড তুষারের ন্যায় নিজের নিকটে অপ্রবুদ্ধ এবং বাহিরের নিকটে অজ্ঞাত হইয়া বিরাজ করিতেছিল। কখন প্রচণ্ড সূর্যের উদয় হইল এবং দেখিতে দেখিতে নানা শিখর হইতে ছুটিয়া আসিয়া তুষারস্রুত বন্যা একবার একত্র স্ফীত হইয়া তাহার পরে উন্মত্ত সহস্র ধারায় জগৎকে চতুর্দিকে আক্রমণ করিতে বাহির হইল।
তখন শ্রান্ত পুরাতন ভারতবর্ষে বৈদিক ধর্ম বৌদ্ধদের দ্বারা পরাস্ত; এবং বৌদ্ধধর্ম বিচিত্র বিকৃত রূপান্তরে ক্রমশ পুরাণ-উপপুরাণের শতধাবিভক্ত ক্ষুদ্র সংকীর্ণ বক্র প্রণালীর মধ্যে স্রোতোহীন মন্দগতিতে প্রবাহিত হইয়া একটি সহস্রলাঙ্গুল শীতরক্ত সরীসৃপের ন্যায় ভারতবর্ষকে শতপাকে জড়িত করিতেছিল। তখন ধর্মে সমাজে শাস্ত্রে কোনো বিষয়ে নবীনতা ছিল না, গতি ছিল না, বৃদ্ধি ছিল না, সকল বিষয়েই যেন পরীক্ষা শেষ হইয়া গেছে, নূতন আশা করিবার বিষয় নাই। সে সময়ে নূতনসৃষ্ট মুসলমানজাতির বিশ্ববিজয়োদীপ্ত নবীন বল সম্বরণ করিবার উপযোগী কোনো একটা উদ্দীপনা ভারতবর্ষের মধ্যে ছিল না।
নবভাবোৎসাহে এবং ঐক্যপ্রবণ ধর্মবলে একটা জাতি যে কিরূপ মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি লাভ করে পরবর্তীকালে শিখগণ তাহার দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছিল।
কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায় নিরুৎসুক হিন্দুগণ মরিতে কুন্ঠিত হয় নাই। মুসলমানেরা যুদ্ধ করিয়াছে, আর হিন্দুরা দলে দলে আত্মহত্যা করিয়াছে। মুসলমানদের যুদ্ধের মধ্যে এক দিকে ধর্মোৎসাহ, অপর দিকে রাজ্য অথবা অর্থ-লোভ ছিল; কিন্তু হিন্দুরা চিতা জ্বালাইয়া স্ত্রীকন্যা ধ্বংস করিয়া আবালবৃদ্ধ মরিয়াছে-- মরা উচিত বিবেচনা করিয়া; বাঁচা তাহাদের শিক্ষাবিরুদ্ধ সংস্কারবিরুদ্ধ বলিয়া। তাহাকে বীরত্ব বলিতে পার কিন্তু তাহাকে যুদ্ধ বলে না। তাহার মধ্যে উদ্দেশ্য অথবা রাষ্ট্রনীতি কিছুই ছিল না।
শাস্ত্রের উপদেশই হউক বা অন্য কোনো ঐতিহাসিক কারণ অথবা জলবায়ুঘটিত নিরুদ্যমবশতই হউক পৃথিবীর উপর হিন্দুদের লুব্ধমুষ্টি অনেকটা শিথিল হইয়া আসিয়াছিল। জগতের কিছুর উপরে তেমন প্রাণপণ দাবি ছিল না। প্রবৃত্তির সেই উগ্রতা না থাকিলে মাংসপেশীতেও যথোচিত শক্তি জোগায় না। গাছ যেমন সহস্র শিকড় দিয়া মাটি কামড়াইয়া থাকে এবং চারি দিক হইতে রস শুষিয়া টানে, যাহারা তেমনি আগ্রহে জগৎকে খুব শক্ত করিয়া না ধরিতে পারে জগৎও তাহাদিগকে ধরিয়া রাখে না। তাহাদের গোড়া আলগা হয়, তাহারা ঝড়ে উলটাইয়া পড়ে। আমরা হিন্দুরা, বিশেষ করিয়া কিছু চাহি না, অন্য প্রাচীরের সন্ধি বিদীর্ণ করিয়া দূরের দিকে শিকড় প্রসারণ করি না -- সেইজন্য, যাহারা চায় তাহাদের সহিত পারিয়া উঠা আমাদের কর্ম নহে।
যাহারা চায় তাহারা যে কেমন করিয়া চায় এই সমালোচ্য গ্রন্থে তাহার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আছে। পৃথিবীর জন্য এমন ভয়ংকর কাড়াকাড়ি রক্তপাত, এত মহাপাতক একত্র আর কোথাও দেখা যায় না। অথচ এই রক্তস্রোতের ভীষণ আবর্তের মধ্য হইতে মাঝে মাঝে দয়াদাক্ষিণ্য ধর্মপরতা রত্নরাজির ন্যায় উৎক্ষিপ্ত হইয়া উঠে।
য়ুরোপীয় খৃস্টানজাতির মধ্যেও এই বিশ্বব্যাপী প্রবৃত্তিক্ষুধা কিরূপ সাংঘাতিক তাহা সমুদ্রতীরের বিলুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় কৃষ্ণ ও রক্তকায় জাতিরা জানে। রূপকথার রাক্ষস যেমন নাসিকা উদ্যত করিয়া আছে, আমিষের ঘ্রাণ পাইলেই গর্জন করিয়া উঠে, "হাঁউ মাঁউ খাঁউ মানুষের গন্ধ পাঁউ--" ইহারা তেমনি কোথাও একটুকরা নূতন জমির সন্ধান পাইলেই দলে দলে চীৎকার করিয়া উঠে, "হাঁউ মাঁউ খাঁউ মাটির গন্ধ পাঁউ। উত্তর আমেরিকার দুর্গম তুষারমরুর মধ্যে স্বর্ণখনির সংবাদ পাইয়া লোভোন্মত্ত নরনারীগণ দীপশিখালুব্ধ পতঙ্গের মতো কেমন উর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়াছে, পথের বাধা, প্রাণের ভয়, অন্নকষ্ট কিছুতেই তাহাদিগকে রোধ করিতে পারে নাই, সে বৃত্তান্ত সংবাদপত্রে সকলেই পাঠ করিয়াছেন। এই যে অচিন্তনীয় কষ্টসাধন-- ইহাতে দেশের উন্নতি করিতে পারে কিন্তু ইহার লক্ষ্য দেশের উন্নতি, জ্ঞানের অর্জন অথবা আর-কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নহে-- ইহার উদ্দীপক দুর্দান্ত লোভ। দুর্যোধনপ্রমুখ কৌরবগণ যেমন লোভের প্ররোচনায় উত্তরের গোগৃহে ছুটিয়াছিল ইহারাও তেমনি ধরণীর স্বর্ণরস দোহন করিয়া লইবার জন্য মৃত্যুসংকুল উত্তরমেরুর দিকে ধাবিত হইয়াছে।
অধিক দিনের কথা নহে, ১৮৭১ খৃস্টাব্দে একটি ইংরাজ দাসদস্যুব্যবসায়ী জাহাজে কিরূপ ব্যাপার ঘটিয়াছিল তাহার বর্ণনাThe Wide World Magazineনামক একটি নূতন সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হইয়াছে। ফিজিদ্বীপে য়ুরোপীয় শস্যক্ষেত্রে মনুষ্য-পিছু তিন পাউন্ড করিয়া মূল্য দেওয়া হইত। সেই লোভে এক দল দাস-চৌর যে কিরূপ অমানুষিক নিষ্ঠুরতার সহিত দক্ষিণসামুদ্রিক দ্বীপপুঞ্জে মনুষ্য শিকার করিত এবং একদা ষাট-সত্তর জন বন্দীকে কিরূপ পিশাচের মতো হত্যা করিয়া সমুদ্রের হাঙর দিয়া খাওয়াইয়াছিল তাহার নিদারুণ বিবরণ পাঠ করিলে খৃস্টানমতের অনন্ত নরকদণ্ডে বিশ্বাস জন্মে।
যে-সকল জাতি বিশ্ববিজয়ী, যাহাদের অসন্তোষ এবং আকাঙক্ষার সীমা নাই, তাহাদের সভ্যতার নিম্নকক্ষে শৃঙ্খলবদ্ধ হিংস্রতা ও উচ্ছৃঙ্খল লোভের যে-একটা পশুশালা গুপ্ত রহিয়াছে, মাঝে মাঝে তাহার আভাস পাইলে কন্টকিত হইতে হয়।
তখন আমাদের মনের মধ্যে এই দ্বন্দ্বের উদয় হয় যে, যে-বৈরাগ্য ভারতবর্ষীয় প্রকৃতিকে পরের অন্নে হস্তপ্রসারণ হইতে নিবৃত্ত করিয়া রাখিয়াছে, দুর্ভিক্ষের উপবাসের দিনেও যাহা তাহাতে শান্তভাবে মরিতে দেয়, তাহা স্বার্থরক্ষার পক্ষে উপযোগী নহে বটে, তথাপি যখন মুসলমানদের ইতিহাসে দেখি উদ্দাম প্রবৃত্তির উত্তেজনার সম্মুখে, ক্ষমতালাভ স্বার্থসাধন সিংহাসনপ্রাপ্তির নিকটে স্বাভাবিক স্নেহ দয়া ধর্ম সমস্তই তুচ্ছ হইয়া যায়; ভাই-ভাই, পিতাপুত্র, স্বামীস্ত্রী, প্রভুভৃত্যের মধ্যে বিদ্রোহ বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, রক্তপাত এবং অকথ্য অনৈসর্গিক নির্মমতার প্রাদুর্ভাব হয়, যখন খৃস্টান ইতিহাসে দেখা যায় আমেরিকায় অস্ট্রেলিয়ায় মাটির লোভে অসহায় দেশবাসীদিগকে পশুদলের মতো উৎসাদিত করিয়া দেওয়া হইয়াছে, লোভান্ধ দাসব্যবসায়িগণ মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে নাই, যখন দেখিতে পাই পৃথিবীটাকে ভাঙিয়া চুরিয়া নিজের কবলে পুরিবার জন্য সর্বপ্রকার বাধা অমান্য করিতে মানুষ প্রস্তুত-- ক্লাইভ, হেস্টিংস তাহাদের নিকট মহাপুরুষ এবং সফলতালাভ রাজনীতির শেষ নীতি -- তখন ভাবি শ্রেয়ের পথ কোন্ দিকে! যদিও জানি যে-বল পশুত্বকে উত্তেজিত করে, সেই বল সময়ক্রমে দেবত্বকে উদ্বোধিত করে, জানি যেখানে আসক্তি প্রবল সেইখানেই আসক্তিত্যাগ সুমহৎ, জানি বৈরাগ্যধর্মের ঔদাসীন্য যেমন প্রকৃতিকে দমন করে তেমনি মনুষ্যত্বে অসাড়তা আনে এবং ইহাও জানি অনুরাগধর্মের নিম্নস্তরে যেমন মোহান্ধকার তেমনি তাহার উচ্চশিখরে ধর্মের নির্মলতম জ্যোতি-- জানি যে, যেখানে মনুষ্যপ্রকৃতির বলশালিতাবশত প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির সংঘর্ষ প্রচণ্ড সেইখানেই দেবগণের ভোগে বিশুদ্ধতম আধ্যাত্মিক অমৃত উন্মথিত হইয়া উঠে, তথাপি লোভ-হিংসার ভীষণ আন্দোলন এবং বিলাসলালসার নিয়ত চাঞ্চল্যের দৃষ্টান্ত দেখিলে ক্ষণকালের জন্য দ্বিধা উপস্থিত হয়, মনে সন্দেহ জাগে যে, পাপ-পুণ্যের ভালো-মন্দের এইরূপ উত্তঙ্গ তরঙ্গিত অসাম্য শ্রেয়, না অপাপের অমন্দের একটি নির্জীব সুবৃহৎ সমতল নিশ্চলতা শ্রেয়! শেষের দিকেই আমাদের অন্তরের আকর্ষণ-- কারণ, বিরাট সংগ্রামের উপযোগী বল আমরা অন্তঃকরণের মধ্যে অনুভব করি না, ধর্ম এবং অর্থ, কাম এবং মোক্ষ এই সব-কটাকে একত্র চালনা করিবার মতো উদ্যম আমাদের নাই-- আমরা সর্বপ্রকার দুরন্ত চেষ্টাকে নিবৃত্ত করিয়া সম্পূর্ণ শান্তিলাভ করিবার প্রয়াসী। কিন্তু শাস্ত্রে যখন ভারতবর্ষকে দুর্গপ্রাচীরের মতো রক্ষা করিতে পারে না, পরজাতির সংঘাত যখন অনিবার্য, যখন লোভের নিকট হইতে স্বার্থরক্ষা এবং হিংসার নিকট হইতে আত্মরক্ষা করিতে আমরা বাধ্য, তখন মানবের মধ্যে যে-দানবটা আছে, সেটাকে সকালে সন্ধ্যায় আমিষ খাওয়াইয়া কিছু না হউক দ্বারের বাহিরেও প্রহরীর মতো বসাইয়া রাখা সংগত। তাহাতে কিছু না হউক, বলশালী লোকের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে।
কিন্তু হায়, ভারতবর্ষে দেব-দানবের যুদ্ধে দানবগুলো একেবারেই গেছে-- দেবতারাও যে খুব সজীব আছেন, তাহা বোধ হয় না। অন্তত সর্বপ্রকার শঙ্কা ও দ্বন্দ্ব-শূন্য হইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন।
শ্রাবণ ১৩০৫