ফকিরের অতিভীষণ অটল গাম্ভীর্যের প্রতি ভ্রূক্ষেপমাত্র না করিয়া পাড়ার লোকেরা তাহাকে ঘিরিয়া বসিয়া বলিতে লাগিল, 'আরে আরে, আমাদের সেই মাখন আজ ঋষি হয়েছেন, তপিস্বী হয়েছেন, চিরটা কাল ইয়ার্কি দিয়ে কাটালে, আজ হঠাৎ মহামুনি জামদগ্নি হয়ে বসেছেন।'
কথাটা উন্নতচেতা ফকিরের অত্যন্ত খারাপ লাগিল, নিরুপায়ে সহ্য করিতে হইল। একজন গায়ের উপর আসিয়া পড়িয়া জিজ্ঞাসা করিল, 'ওরে মাখন, তুই কুচকুচে কালো ছিলি, রঙটা এমন ফর্সা করলি কী করে!'
ফকির উত্তর দিল, 'যোগ অভ্যাস ক'রে।'
সকলেই বলিল, 'যোগের কী আশ্চর্য প্রভাব।'
একজন উত্তর করিল, 'আশ্চর্য আর কী। শাস্ত্রে আছে, ভীম যখন হনুমানের লেজ ধরে তুলতে গেলেন, কিছুতেই তুলতে পারলেন না। সে কী ক'রে হল। সে তো যোগ-বলে।'
এ কথা সকলকেই স্বীকার করিতে হইল।
হেনকালে ষষ্ঠীচরণ আসিয়া ফকিরকে বলিল, 'বাবা, একবার বাড়ির ভিতরে যেতে হচ্ছে।'
এ সম্ভাবনাটা ফকিরের মাথায় উদয় হয় নাই-- হঠাৎ বজ্রাঘাতের মতো মস্তিষ্কে প্রবেশ করিল। অনেকক্ষণ চুপ করিয়া, পাড়ার লোকের বিস্তর অন্যায় পরিহাস পরিপাক করিয়া অবশেষে বলিল, 'বাবা, আমি সন্ন্যাসী হয়েছি, আমি অন্তঃপুরে ঢুকতে পারব না।'
ষষ্ঠীচরণ পাড়ার লোকদের সম্বোধন করিয়া বলিল, 'তা হলে আপনাদের একবার গা তুলতে হচ্ছে। বউমাদের এইখানেই নিয়ে আসি। তাঁরা বড়ো ব্যাকুল হয়ে আছেন।'
সকলে উঠিয়া গেল। ফকির ভাবিল, এইবেলা এখান হইতে এক দৌড় মারি। কিন্তু, রাস্তায় বাহির হইলেই পাড়ার লোক কুক্কুরের মতো তাহার পশ্চাতে ছুটিবে ইহাই কল্পনা করিয়া তাহাকে নিস্তব্ধভাবে বসিয়া থাকিতে হইল।
যেমনি মাখনলালের দুই স্ত্রী প্রবেশ করিল ফকির অমনি নতশিরে তাহাদিগকে প্রণাম করিয়া কহিল, 'মা, আমি তোমাদের সন্তান।'
অমনি ফকিরের নাকের সম্মুখে একটা বালা-পরা হাত খড়্গের মতো খেলিয়া গেল এবং একটি কাংস্যবিনিন্দিত কণ্ঠে বাজিয়া উঠিল, 'ওরে ও পোড়াকপালে মিন্সে, তুই মা বললি কাকে!'
অমনি আর-একটি কণ্ঠ আরো দুই সুর উচ্চে পাড়া কাঁপাইয়া ঝংকার দিয়া উঠিল, 'চোখের মাথা খেয়েছিস! তোর মরণ হয় না!'
নিজের স্ত্রীর নিকট হইতে এরূপ চলিত বাংলা শোনা অভ্যাস ছিল না, সুতরাং একান্ত কাতর হইয়া ফকির জোড়হস্তে কহিল, 'আপনারা ভুল বুঝছেন। আমি এই আলোতে দাঁড়াচ্ছি, আমাকে একটু ঠাউরে দেখুন!'
প্রথমা ও দ্বিতীয়া পরে পরে কহিল, 'ঢের দেখেছি। দেখে দেখে চোখ ক্ষয়ে গেছে। তুমি কচি খোকা নও, আজ নতুন জন্মাও নি। তোমার দুধের দাঁত অনেক দিন ভেঙেছে। তোমার কি বয়সের গাছ-পাথর আছে। তোমায় যম ভুলেছে বলে কি আমরা ভুলব।'
এরূপ এক-তরফা দাম্পত্য আলাপ কতক্ষণ চলিত বলা যায় না -- কারণ, ফকির একেবারে বাক্শক্তিরহিত হইয়া নতশিরে দাঁড়াইয়া ছিল। এমন সময় অত্যন্ত কোলাহল শুনিয়া এবং পথে লোক জমিতে দেখিয়া ষষ্ঠীচরণ প্রবেশ করিল। বলিল,'এতদিন আমার ঘর নিস্তব্ধ ছিল,একেবারে টুঁ শব্দ ছিল না। আজ মনে হচ্ছে বটে, আমার মাখন ফিরে এসেছে।'
ফকির করজোড়ে কহিল, 'মশায়,আপনার পুত্রবধূদের হাত থেকে আমাকে রক্ষে করুন।'
ষষ্ঠী। বাবা, অনেক দিন পরে এসেছ, তাই প্রথমটা একটু অসহ্য বোধ হচ্ছে। তা, মা তোমরা এখন যাও। বাবা মাখন তো এখন এখানেই রইলেন, ওঁকে আর কিছুতেই যেতে দিচ্ছি নে।
ললনাদ্বয় বিদায় হইলে ফকির ষষ্ঠীচরণকে বলিল, 'মশায়, আপনার পুত্র কেন যে সংসার ত্যাগ করে গেছেন তা আমি সম্পূর্ণ অনুভব করতে পারছি। মশায়, আমার প্রণাম জানবেন, আমি চললেম।'
বৃদ্ধ এম্নি উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন উত্থাপন করিল যে, পাড়ার লোক মনে করিল মাখন তাহার বাপকে মারিয়াছে। তাহারা হাঁ-হাঁ করিয়া ছুটিয়া আসিল। সকলে আসিয়া ফকিরকে জানাইয়া দিল, এমন ভণ্ডতপস্বীগিরি এখানে খাটিবে না। ভালোমানুষের ছেলের মতো কাল কাটাইতে হইবে। একজন বলিল, 'ইনি তো পরমহংস নন, পরম বক।'
গাম্ভীর্য গোঁফদাড়ি এবং গলাবন্ধের জোরে ফকিরকে এমন-সকল কুৎসিত কথা কখনো শুনিতে হয় নাই। যাহা হউক, লোকটা পাছে আবার পালায় পাড়ার লোকেরা অত্যন্ত সতর্ক রহিল। স্বয়ং জমিদার ষষ্ঠীচরণের পক্ষ অবলম্বন করিলেন।