দিদির যত্নে ও সেবায় নীলমণি তাহার বিপদের কাল উত্তীর্ণ হইয়া ছয় বৎসরে পা দিল।
কার্তিক মসে ভাইফোঁটার দিনে নূতন জামা চাদর এবং একখানি লালপেড়ে ধুতি পরাইয়া বাবু সাজাইয়া নীলমণিকে শশী ভাইফোঁটা দিতেছেন এমন সময়ে পূর্বোক্ত স্পষ্টভাষিণী প্রতিবেশিনী তারা আসিয়া কথায় কথায় শশীর সহিত ঝগড়া বাধাইয়া দিল।
সে কহিল, গোপনে ভাইয়ের সর্বনাশ করিয়া ঘটা করিয়া ভাইয়ের কাপালে ফোঁটা দিবার কোনো ফল নাই।
শুনিয়া শশী বিস্ময়ে ক্রোধে বেদনায় বজ্রাহত হইল। অবশেষে শুনিতে পাইল, তাহারা স্বামীস্ত্রীতে পরামর্শ করিয়া নাবালক নীলমণির সম্পত্তি খাজনার দায়ে নিলাম করাইয়া তাহার স্বামীর পিসতুতো ভাইয়ের নামে বেনামি করিয়া কিনিতেছে।
শুনিয়া শশী অভিশাপ দিল, যাহারা এতবড়ো মিথ্যা কথা রটনা করিতে পারে তাহাদের মুখে কুষ্ঠ হউক।
এই বলিয়া সরোদনে স্বামীর নিকট উপস্থিত হইয়া জনশ্রুতির কথা তাহাকে জানাইল।
জয়গোপাল কহিল, 'আজকালকার দিনে কাহাকেও বিশ্বাস করিবার জো নাই। উপেন আমার আপন পিসতুতো ভাই, তাহার উপরে বিষয়ের ভার দিয়া আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত ছিলাম-- সে কখন গোপনে খাজনা বাকি ফেলিয়া মহল হাসিলপুর নিজে কিনিয়া লইয়াছে, আমি জানিতেও পারি নাই।'
শশী আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, 'নালিশ করিবে না?'
জয়গোপাল কহিল, 'ভাইয়ের নামে নালিশ করি কী করিয়া। এবং নালিশ করিয়াও তো কোনো ফল নাই, কেবল অর্থ নষ্ট।'
স্বামীর কথা বিশ্বাস করা শশীর পরম কর্তব্য, কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস করিতে পারিল না। তখন এই সুখের সংসার, এই প্রেমের গার্হস্থ্য সহসা তাহার নিকট অত্যন্ত বিকট বীভৎস আকার ধারণ করিয়া দেখা দিল। যে সংসারকে আপনার পরম আশ্রয় বলিয়া মনে হইত, হঠাৎ দেখিল, সে একটা নিষ্ঠুর স্বার্থের ফাঁদ-- তাহাদের দুটি ভাইবোনকে চারি দিক হইতে ঘিরিয়া ধরিয়াছে। সে একা স্ত্রীলোক, অসহায় নীলমণিকে কেমন করিয়া রক্ষা করিবে ভাবিয়া কূলকিনারা পাইল না। যতই চিন্তা করিতে লাগিল ততই ভয়ে এবং ঘৃণায় এবং বিপন্ন বালক ভ্রাতাটির প্রতি অপরিসীম স্নেহে তাহার হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, সে যদি উপায় জানিত তবে লাটসাহেবের নিকট নিবেদন করিয়া, এমন-কি, মহারানীর নিকট পত্র লিখিয়া তাহার ভাইয়ের সম্পত্তি রক্ষা করিতে পারিত। মহারানী কখনোই নীলমণির বার্ষিক সাতশো আটান্ন টাকা মুনাফার হাসিলপুর মহল বিক্রয় হইতে দিতেন না।
এইরূপে শশী যখন একেবারে মহারানীর নিকট দরবার করিয়া তাহার পিসতুতো দেবরকে সম্পূর্ণ জব্দ করিয়া দিবার উপায় চিন্তা করিতেছে তখন হঠাৎ নীলমণির জ্বর আসিয়া আক্ষেপ-সহকারে মূর্ছা হইতে লাগিল।
জয়গোপাল এক গ্রাম্য নেটিভ ডাক্তারকে ডাকিল। শশী ভালো ডাক্তারের জন্য অনুরোধ করাতে জয়গোপাল বলিল, 'কেন, মতিলাল মন্দ ডাক্তার কী!'
শশী তখন তাঁহার পায়ে পড়িল, মাথার দিব্য দিল; জয়গোপাল বলিল, 'আচ্ছা, শহর হইতে ডাক্তার ডাকিতে পাঠাইতেছি।'
শশী নীলমণিকে কোলে করিয়া, বুকে করিয়া পড়িয়া রহিল। নীলমণিও তাহাকে একদণ্ড চোখের আড়াল হইতে দেয় না; পাছে ফাঁকি দিয়া পালায় এই ভয়ে তাহাকে জড়াইয়া থাকে, এমন-কি, ঘুমাইয়া পড়িলেও আঁচলটি ছাড়ে না।
সমস্ত দিন এমনি ভাবে কাটিলে সন্ধ্যার পর জয়গোপাল আসিয়া বলিল, 'শহরে ডাক্তারবাবুকে পাওয়া গেল না, তিনি দূরে কোথায় রোগী দেখিতে গিয়াছেন।' ইহাও বলিল, 'মকদ্দমা-উপলক্ষে আমাকে আজই অন্যত্র যাইতে হইতেছে; আমি মতিলালকে বলিয়া গেলাম, সে নিয়মিত আসিয়া রোগী দেখিয়া যাইবে।'
রাত্রে নীলমণি ঘুমের ঘোরে প্রলাপ বকিল। প্রাতঃকালেই শশী কিছুমাত্র বিচার না করিয়া রোগী ভ্রাতাকে লইয়া নৌকা চড়িয়া একেবারে শহরে গিয়া ডাক্তারের বাড়ি উপস্থিত হইল। ডাক্তার বাড়িতেই আছেন, শহর ছাড়িয়া কোথাও যান নাই। ভদ্রস্ত্রীলোক দেখিয়া তিনি তাড়াতাড়ি বাসা ঠিক করিয়া প্রাচীনা বিধবার তত্ত্বাবধানে শশীকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিলেন এবং ছেলেটির চিকিৎসা আরম্ভ করিলেন।
পরদিনই জয়গোপাল আসিয়া উপস্থিত। ক্রোধে অগ্নিমূর্তি হইয়া স্ত্রীকে তৎক্ষণাৎ তাহার সহিত ফিরিতে অনুমতি করিল।
স্ত্রী কহিল, 'আমাকে যদি কাটিয়া ফেল তবু আমি এখন ফিরিব না; তোমরা আমার নীলমণিকে মারিয়া ফেলিতে চাও; উহার মা নাই, বাপ নাই, আমি ছাড়া উহার আর কেহ নাই, আমি উহাকে রক্ষা করিব।'
জয়গোপাল রাগিয়া কহিল, 'তবে এইখানেই থাকো, তুমি আর আমার ঘরে ফিরিয়ো না।'
শশী তখন প্রদীপ্ত হইয়া উঠিয়া কহিল, 'ঘর তোমার কী! আমার ভাইয়েরই তো ঘর।'
জয়গোপাল কহিল, 'আচ্ছা, সে দেখা যাইবে!'
পাড়ার লোকে এই ঘটনায় কিছুদিন খুব আন্দোলন করিতে লাগিল। প্রতিবেশিনী তারা কহিল, 'স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করিতে হয় ঘরে বসিয়া কর্-না, বাপু; ঘর ছাড়িয়া যাইবার আবশ্যক কী। হাজার হউক, স্বামী তো বটে।'
সঙ্গে যাহা টাকা ছিল সমস্ত খরচ করিয়া, গহনাপত্র বেচিয়া শশী তাহার ভাইকে মৃত্যুমুখ হইতে রক্ষা করিল। তখন সে খবর পাইল, দ্বারিগ্রামে তাহাদের যে বড়ো জোত ছিল, যে জোতের উপরে তাহাদের বাড়ি, নানারূপে যাহার আয় প্রায় বার্ষিক দেড়হাজার টাকা হইবে, সেই জোতটি জমিদারের সহিত যোগ করিয়া জয়গোপাল নিজের নামে খারিজ করিয়া লইয়াছে। এখন বিষয়টি সমস্তই তাহাদের, তাহার ভাইয়ের নহে।
ব্যামো হইতে সারিয়া উঠিয়া নীলমণি করুণস্বরে বলিতে লাগিল, 'দিদি, বাড়ি চলো।' সেখানে তাহার সঙ্গী ভাগিনেয়দের জন্য তাহার মন-কেমন করিতেছে। তাই বারংবার বলিল, 'দিদি, আমাদের সেই ঘরে চলো-না, দিদি!' শুনিয়া দিদি কেবলই কাঁদিতে লাগিল। 'আমাদের ঘর আর কোথায়!'
কিন্তু কেবল কাঁদিয়া কোনো ফল নাই, তখন পৃথিবীতে দিদি ছাড়া তাহার ভাইয়ের আর কেহ ছিল না। ইহা ভাবিয়া চোখের জল মুছিয়া শশী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট তারিণীবাবুর অন্তঃপুরে গিয়া তাঁহার স্ত্রীকে ধরিল।
ডেপুটিবাবু জয়গোপালকে চিনিতেন। ভদ্রঘরের স্ত্রী ঘরের বাহির হইয়া বিষয়-সম্পত্তি লইয়া স্বামীর সহিত বিবাদে প্রবৃত্ত হইতে চাহে, ইহাতে শশীর প্রতি তিনি বিশেষ বিরক্ত হইলেন। তাহাকে ভুলাইয়া রাখিয়া তৎক্ষণাৎ জয়গোপালকে পত্র লিখিলেন। জয়গোপাল শ্যালকসহ তাহার স্ত্রীকে বলপূর্বক নৌকায় তুলিয়া বাড়ি লইয়া গিয়া উপস্থিত করিল।
স্বামিস্ত্রীতে দ্বিতীয় বিচ্ছেদের পর পুনশ্চ এই দ্বিতীয়বার মিলন হইল। প্রজাপতির নির্বন্ধ!
অনেকদিন পরে ঘরে ফিরিয়া পুরাতন সহচরদিগকে পাইয়া নীলমণি বড়ো আনন্দে খেলিয়া বেড়াইতে লাগিল। তাহার সেই নিশিন্ত আনন্দ দেখিয়া অন্তরে অন্তরে শরীর হৃদয় বিদীর্ণ হইল।