সুকুমারী। দেখো দেখি, এখন সতীশ কেমন পরিশ্রম করে কাজকর্ম করছে। দেখো, অতবড়ো সাহেব-বাবু আজকাল পুরানো কালো আলপাকার চাপকানের উপরে কোঁচানো চাদর ঝুলিয়ে কেমন নিয়মিত আপিসে যায়!

শশধর। বড়োসাহেব সতীশের খুব প্রসংসা করেন।

সুকুমারী। দেখো দেখি, তুমি যদি তোমার জমিদারিটা তাকে দিয়ে বসতে তবে এতদিনে সে টাই-কলার-জুতা-ছড়ি কিনেই সেটা নিলামে চড়িয়ে দিত। ভাগ্যে আমার পরামর্শ নিয়েছো, তাই তো সতীশ মানুষের মতো হয়েছে।

শশধর । বিধাতা আমাদের বুদ্ধি দেননি কিন্তু স্ত্রী দিয়েছেন, আর তোমাদের বুদ্ধি দিয়েছেন তেমনি সঙ্গে সঙ্গে নির্বোধ স্বামীগুলাকেও তোমাদের হাতে সমর্পণ করেছে-- আমাদেরই জিত।

সুকুমারী। আচ্ছা আচ্ছা, ঢের হয়েছে, ঠাট্টা করতে হবে না! কিন্তু সতীশের পিছনে এতদিন যে টাকাটা ঢেলেছ সে যদি আজ থাকত-- তবে--

শশধর। সতীশ তো বলেছে, কোনো-একদিন সে সমস্তই শোধ করে দেবে।

সুকুমারী। সে যত শোধ করবে আমার গায়ে রইল! সে তো বরাবরই ঐরকম লম্বাচৌড়া কথা বলে থাকে। তুমি বুঝি সেই ভরসায় পথ চেয়ে বসে আছ!

শশধর। এতদিন তো ভরসা ছিল, তুমি যদি পরামর্শ দাও তো সেটা বিসর্জন দিই।

সুকুমারী। দিলে তোমার বেশি লোকসান হবে না, এই পর্যন্ত বলতে পারি। ঐ-যে তোমার সতীশবাবু আসছেন। চাকরি হয়ে অবধি একদিনও তো আমাদের চৌকাঠ মাড়ান নি, এমনি তাঁর কৃতজ্ঞতা! আমি যাই।

সতীশের প্রবেশ

সতীশ। মাসিমা, পালাতে হবে না । এই দেখো, আমার হাতে অস্ত্রশস্ত্র কিছুই নেই-- কেবল খান কয়েক নোট আছে।

শশধর। ইস্‌! এ যে একতাড়া নোট! যদি আপিসের টাকা হয় তো এমন করে সঙ্গে নিয়ে বেড়ানো ভালো হচ্ছে না, সতীশ।

সতীশ। আর সঙ্গে নিয়ে বেড়াব না । মাসিমার পায়ে বিসর্জন দিলাম। প্রণাম হই, মাসিমা। বিস্তর অনুগ্রহ করেছিলে-- তখন তার হিসাব রাখতে হবে মনেও করিনি,সুতরাং পরিশোধের অঙ্কে কিছু ভুলচুক হতে পারে। এই পনেরো হজোর টাকা গুনে নাও। তোমার খোকার পোলাও-পরমান্নে একটি তণ্ডুলকণাও কম না পড়ুক।

শশধর । এ কী কাণ্ড সতীশ! এত টাকা কোথায় পেলে।

সতীশ । আমি গুন্‌চট আজ ছয় মাস আগাম খরিদ করে রেখেছি-- ইতিমধ্যে দর চড়েছে; তাই মুনফা পেয়েছি।

শশধর। সতীশ, এ যে জুয়া খেলা।

সতীশ। খেলা এইখানেই শেষ-- আর দরকার হবে না।

শশধর। তোমার এ টাকা তুমি নিয়ে যাও,আমি চাই না।

সতীশ। তোমাকে তো দিইনি মেসোমশায় । এ মাসিমার ঋণশোধ। তোমার ঋণ কোনোকালে শোধ করতে পারব না ।

শশধর। কী সুকু,এ টাকাগুলো--

সুকুমারী। গুনে খাতাঞ্চির হাতে দাও না-- ঐখানেই কি ছড়ানো পড়ে থাকবে।

শশধর। সতীশ, খেয়ে এসেছ তো?

সতীশ । বাড়ি গিয়ে খাব।

শশধর। অ্যাঁ, সে কী কথা। বেলা যে বিস্তর হয়েছে। আজ এইখানেই খেয়ে যাও।

সতীশ। আর খাওয়া নয় মেসোমশায়। একদফা শোধ করলেম, অন্নঋণ আবার নূতন করে ফাঁদতে পারব না।

প্রস্থান

সুকুমারী। বাপের হাত হতে রক্ষা করে এতদিন ওকে খাইয়ে-পড়িয়ে মানুষ করলেম, আজ হাতে দু-পয়সা আসতেই ভাবখানা দেখেছ! কৃতজ্ঞতা এমনিই বটে! ঘোর কলি কিনা।
1...10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 | 16 | 17 | 18