হরলাল অনেক চেষ্টা করিয়াও পড়াতে আর তেমন করিয়া মনেযোগ করিতে পারিল না। সে কোনোমতেই স্থির হইয়া পড়িতে বসিতে পারিত না। সে খানিকটা পড়িবার চেষ্টা করিয়াই ধাঁ করিয়া বই বন্ধ করিয়া ফেলিত এবং অকারণে দ্রুতপদে রাস্তায় ঘুরিয়া আসিত। কলেজে লেক্‌চারের নোটের মাঝে মাঝে খুব বড়ো বড়ো ফাঁক পড়িত এবং মাঝে মাঝে যে-সমস্ত আঁকজোঁক পাড়িত তাহার সঙ্গে প্রাচীন ঈজিপ্টের চিত্রলিপি ছাড়া আর কোনো বর্ণমালার সাদৃশ্য ছিল না।

হরলাল বুঝিল, এ-সমস্ত ভাল লক্ষণ নয়। পরীক্ষায় সে যদি বা পাশ হয় বৃত্তি পাইবার কোনো সম্ভাবনা নাই। বৃত্তি না পাইলে কলিকাতায় তাহার একদিনও চলিবে না। ও দিকে দেশে মাকেও দু-চার টাকা পাঠানো চাই। নানা চিন্তা করিয়া চাকরির চেষ্টায় বাহির হইল। চাকরি পাওয়া কঠিন, কিন্তু না পাওয়া তাহার পক্ষে আরো কঠিন; এইজন্য আশা ছাড়িয়াও আশা ছাড়িতে পারিল না।

হরলালের সৌভাগ্যক্রমে একটি বড়ো ইংরেজ সদাগরের আপিসে উমেদারি করিতে গিয়া হঠাৎ সে বড়োসাহেবের নজরে পড়িল। সাহেবের বিশ্বাস ছিল তিনি মুখ দেখিয়া লোক চিনিতে পারেন। হরলালকে ডাকিয়া তাহার সঙ্গে দু-চার কথা কহিয়াই তিনি মনে মনে বলিলেন,এ লোকটা চলিবে। জিজ্ঞাসা করিলেন,' কাজ জানা আছে?' হরলাল কহিল,' না। ' 'জামিন দিতে পারিবে?' তাহার উত্তরেও 'না'। 'কোনো বড়োলোকের কাছ হইতে সার্টিফিকেট আনিতে পার?' কোনো বড়োলোককেই সে জানে না।

শুনিয়া সাহেব আরো যেন খুশি হইয়াই কহিলেন,'আচ্ছা বেশ,পঁচিশ টাকা বেতনে কাজ আরম্ভ করো, কাজ শিখিলে উন্নতি হইবে।' তার পরে সাহেব তাহার বেশভূষার প্রতি দৃষ্টি করিয়া কহিলেন, ' পনেরো টাকা আগাম দিতেছি-- আপিসের উপযুক্ত কাপড় তৈরি করাইয়া লইবে।'

কাপড় তৈরি হইল, হরলাল আপিসেও বাহির হইতে আরম্ভ করিল। বড়োসাহেব তাহাকে ভুতের মতো খাটাইতে লাগিলেন। অন্য কেরানিরা বাড়ি গেলেও হরলালের ছুটি ছিল না । এক-একদিন সাহেবের বাড়ি গিয়াও তাঁহাকে কাজ বুঝাইয়া দিয়া আসিতে হইত।

এমনি করিয়া কাজ শিখিয়া লইতে হরলালের বিলম্ব হইল না। তাহার সহযোগী কেরানিরা তাহাকে ঠেকাইবার অনেক চেষ্টা করিল, তাহার বিরুদ্ধে উপরওয়ালার কাছে লাগালাগিও করিল, কিন্তু এই নিঃশব্দ নিরীহ সামান্য হরলালের কোনো অপকার করিতে পারিল না।

যখন তাহার চল্লিশ টাকা মাহিনা হইল,তখন হরলাল দেশ হইতে মাকে আনিয়া একটা ছোটোখাটো গলির মধ্যে ছোটোখাটো বাড়িতে বাসা করিল। এতদিন পরে তাহার মার দুঃখ ঘুচিল। মা বলিলেন, 'বাবা, এইবার বউ ঘরে আনিব।' হরলাল মাতার পায়ের ধুলা লইয়া বলিল,' মা, ঐটে মাপ করিতে হইবে।'

মাতার আর-একটি অনুরোধ ছিল। তিনি বলিতেন ,' তুই যে দিনরাত তোর ছাত্র বেণুগোপালের গল্প করিস, তাহাকে একবার নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়া। তাহাকে আমার দেখিতে ইচ্ছা করে।'

হরলাল কহিল,' মা, এ বাসায় তাহাকে কোথায় বসাইব। রোসো,একটা বড়ো বাসা করি, তাহার পরে তাহাকে নিমন্ত্রণ করিব।'
1...3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 | 9 | 10 | 11