'দোহাই তোমার, আরো-একটু ঘন ঘন ডেকো। দরকার থাকে তো ভালো, না থাকে তো আরো ভালো।'
'আপনি জানেন, দামী যন্ত্র সংগ্রহের নেশায় আমার স্বামীর কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান থাকত না। মনিবদের ফাঁকি দিতেন এই নিষ্কাম লোভে। সমস্ত এসিয়ার মধ্যে এমন ল্যাবরেটরি কোথাও পাওয়া যাবে না, এই জেদ তাঁর মতো আমাকেও পেয়ে বসেছিল। এই জেদেই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, নইলে আমার মোদো রক্ত গাঁজিয়ে উঠে উপচিয়ে পড়ত চার দিকে। দেখুন চৌধুরীমশায়, নিজের স্বভাবের মধ্যে মন্দটা যা লেপটিয়ে থাকে সেটা যাঁর কাছে অসংকোচে বলতে পারি আপনি আমার সেই বন্ধু। নিজের কলঙ্কের দিকটা দেখাবার খোলসা দরজা পেলে মন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।'
চৌধুরী বললেন, 'যারা সম্পূর্ণটা দেখতে পায় তাদের কাছে সত্যকে চাপা দেবার দরকার করে না। আধা সত্যই লজ্জার জিনিস। পুরোপুরি দেখার ধাত আমাদের, আমরা বিজ্ঞানী।'
'তিনি বলতেন, মানুষ প্রাণপণে প্রাণ বাঁচাতে চায় কিন্তু প্রাণ তো বাঁচে না। সেইজন্যে বাঁচবার শখ মেটাবার জন্যে এমন কিছুকে সে খুঁজে বেড়ায় যা প্রাণের চেয়ে অনেক বেশি। সেই দুর্লভ জিনিসকে তিনি পেয়েছেন তাঁর ল্যাবরেটরিতে। একে যদি আমি বাঁচিয়ে রাখতে না পারি তা হলেই তাঁকে চরম করে মারব স্বামীঘাতিনী হয়ে। আমি এর রক্ষক চাই, তাই খুঁজছিলুম রেবতীকে।'
'চেষ্টা করে দেখলে?'
'দেখেছি, হাতে হাতে ফল পাবার আশা আছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিঁকবে না।'
'কেন।'
'ওঁর পিসিমা যেমনি শুনবেন রেবতীকে টেনেছি কাছে, অমনি তাঁকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবার জন্যে ছুটে আসবেন। ভাববেন, আমার মেয়ের সঙ্গে ওঁর বিয়ে দেবার ফাঁদ পেতেছি।'
'দোষ কী, হলে তো ভালোই হত। কিন্তু তুমি যে বলেছিলে, বেজাতে মেয়ের বিয়ে দেবে না।'
'তখনো আপনার মন জানতুম না, তাই মিথ্যে কথা বলেছিলুম। খুবই চেয়েছিলুম। কিন্তু ছেড়েছি সেই মতলব।'
'কেন।'
'বুঝতে পেরেছি, ও ভাঙনধরানো মেয়ে। ওর হাতে যা পড়বে তা আস্ত থাকবে না।'
'কিন্তু ও তো তোমারই মেয়ে।'
'আমারই মেয়ে তো বটে, তাই তো ওকে আঁতের ভিতর থেকেই চিনি।'
অধ্যাপক বললেন, 'কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে কেন যে, মেয়েরা পুরুষের ইন্স্পিরেশন জাগাতে পারে।'
'আমার সবই জানা আছে। পুরুষের খোরাকে আমিষ পর্যন্ত ভালোই চলে কিন্তু মদ ধরালেই সর্বনাশ। আমার মেয়েটি মদের পাত্র, কানায় কানায় ভরা।'
'তা হলে কী করতে চাও বলো।'
'আমার ল্যাবরেটরি দান করতে চাই পাবলিককে।'
'তোমার একমাত্র মেয়েকে এড়িয়ে দিয়ে?'
'মেয়েকে? ওকে দান করলে সে দান পৌঁছবে কোন্ রসাতলে কী করে জানব। আমার ট্রাস্ট সম্পত্তির প্রেসিডেন্ট করে দেব রেবতীকে। তাতে তো পিসির আপত্তি হতে পারবে না?'
'মেয়েদের আপত্তির যুক্তি যদি ধরতেই পারব তা হলে পুরুষ হয়ে জন্মাতে গেলুম কেন। কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি নে, ওকে যদি জামাই না করবে তা হলে প্রেসিডেন্ট করতে চাও কেন।'
'শুধু যন্ত্রগুলো নিয়ে কী হবে। মানুষ চাই ওদের প্রাণ দিতে। আর-একটা কথা এই, আমার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে একটাও নতুন যন্ত্র আনা হয় নি। টাকার অভাবে নয়। কিনতে হলে একটা লক্ষ্য ধরে কিনতে হয়। খবর জেনেছি, রেবতী ম্যাগ্নেটিজ্ম্ নিয়ে কাজ করেছেন। সেই পথে সংগ্রহ এগিয়ে চলুক, যত দাম লাগে লাগুক্-না।'
'কী আর বলব, পুরুষমানুষ যদি হতে তোমাকে কাঁধে করে নিয়ে নেচে বেড়াতুম। তোমার স্বামী রেল-কোম্পানির টাকা চুরি করেছিলেন, তুমি চুরি করে নিয়েছ তাঁর পুরুষের মনখানা। এমন অদ্ভুত কলমের জোড়-লাগানো বুদ্ধি আমি কখনো দেখি নি। আমারও পরামর্শ নেওয়া তুমি যে দরকার বোধ কর, এই আশ্চর্য।'
'তার কারণ আপনি যে খুব খাঁটি, ঠিক কথা বলতে জানেন।'
'হাসালে তুমি। তোমাকে বেঠিক কথা ব'লে ধরা পড়ব, এত বড়ো নিরেট বোকা আমি নই। তা হলে লাগা যাক এবার, জিনিসপত্র ফর্দ করা, দর যাচাই করা, ভালো উকিল ডেকে তোমার স্বত্ব বিচার করা, আদনকানুন বেঁধে দেওয়া ইত্যাদি অনেক হাঙ্গামা আছে।'
'এ-সব দায় কিন্তু আপনারই।'
'সেটা হবে নামমাত্র। বেশ ভালো করেই জান, যা তুমি বলাবে তাই বলব, যা করাবে তাই করব। আমার লাভটা এই দুবেলা দেখা হবে তোমার সঙ্গে। তোমাকে যে কী চক্ষে দেখেছি তুমি তো জান না।'
সোহিনী চৌকি থেকে উঠে এসে ধাঁ করে এক হাতে চৌধুরীর গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমো খেয়ে চট্ করে সরে গেল, ভালোমানুষের মতো বসল গিয়ে চৌকিতে।
'ঐ রে সর্বনাশের শুরু হল দেখছি।'
'সে ভয় যদি একটুও থাকত তা হলে কাছেও এগতুম না। এ বরাদ্দ আপনার জুটবে মাঝে মাঝে।'
'ঠিক বলছ?'
'ঠিকই বলছি। আমার এতে খরচ নেই, আপনারও যে বেশি কিছু পাওনা আছে, মুখের ভাব দেখে তা বোধ হচ্ছে না।''
'অর্থাৎ বলতে চাও, এ হচ্ছে মরা কাঠে কাঠঠোকরার ঠোকর দেওয়া। -- চললুম উকিলবাড়িতে।'
'কাল একবার আসবেন এ পাড়াতে।'
'কেন, কী করতে।'
'রেবতীর মনে দম দিতে।'
'আর নিজের মনটা খুইয়ে বসতে।'
'মন কি আপনার একলারই আছে।'
'তোমার মনের কিছু বাকি আছে নাকি।'
'উচ্ছিষ্ট অনেক পড়ে আছে।'
'তাতে এখনো অনেক বাঁদর নাচানো চলবে।'