অচিরার সঙ্গে আমার অপরিচয়ের ব্যবধান ক্ষয় হয়ে আসছে। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে যেন পরিচয়টাই ব্যবধান। কাছাকাছি আসছি বটে কিন্তু তাতে একটা প্রতিঘাত জাগছে। কেন? অচিরার প্রতি আমার ভালোবাসা ওর কাছে স্পষ্ট হয়ে আসছে, অপরাধ কি তারই মধ্যে। কিংবা আমার দিকে ওর সৌহৃদ্য স্ফুটতর হয়ে উঠছে, সেইটেতেই ওর গ্লানি। কে জানে।
সেদিন চড়িভাতি তনিকা নদীর তীরে।
অচিরা ডাক দিলে, 'ডাক্তার সেনগুপ্ত।'
আমি বললুম, 'সেই প্রাণীটার কোনো ঠিকানা নেই, সুতরাং কোনো জবাব মিলবে না।'
'আচ্ছা, তা হলে নবীনবাবু।'
'সেও ভালো, যাকে বলে মন্দর ভালো।'
'কাণ্ডটা কী দেখলেন তো?'
আমি বললুম, 'আমার সামনে লক্ষ্য করবার বিষয় কেবল একটিমাত্রই ছিল, আর কিছুই ছিল না।'
এইটুকু ঠাট্টায় অচিরা সত্যই বিরক্ত হয়ে বললে, 'আপনার আলাপ ক্রমেই যদি অমন ইশারাওয়ালা হয়ে উঠতে থাকে তা হলে ফিরিয়ে আনব ডাক্তার সেনগুপ্তকে, তাঁর স্বভাব ছিল গম্ভীর।'
আমি বললুম, 'আচ্ছা তা হলে কাণ্ডটা কী হয়েছিল বলুন।'
'ঠাকুর যে ভাত রেঁধেছিল সে কড়্কড়ে, আদ্ধেক তার চাল। আমি বললুম, দাদু, এ তো তোমার চলবে না। দাদু অমনি ব'লে বসলেন, জান তো ভাই, খাবার জিনিস শক্ত হলে ভালো করে চিবোবার দরকার হয়, তাতেই হজমের সাহায্য করে। পাছে আমি দুঃখ করি দাদুর জেগে উঠল সায়েন্সের বিদ্যে। নিমকিতে নুনের বদলে যদি চিনি দিত তা হলে নিশ্চয় দাদু বলত, চিনিতে শরীরের এনার্জি বাড়িয়ে দেয়।'
'দাদু, ও দাদু, তুমি ওখানে বসে বসে কী পড়ছ। আমি যে এদিকে তোমার চরিত্রে অতিশয়োক্তি - অলংকার আরোপ করছি, আর নবীনবাবু সমস্তই বেদবাক্য ব'লে বিশ্বাস করে নিচ্ছেন।'
কিছু দূরে পোড়ো মন্দিরের সিঁড়ির উপরে বসে অধ্যাপক বিলিতি ত্রৈমাসিক পড়ছিলেন। অচিরার ডাক শুনে সেখান থেকে উঠে আমাদের কাছে বসলেন। ছেলেমানুষের মতো হঠাৎ আমাকে জিগ্গেসা করলেন, 'আচ্ছা নবীন, তোমার কি বিবাহ হয়েছে।'
কথাটা এতই সুস্পষ্ট ভাবব্যঞ্জক যে আর কেউ হলে বলত 'না', কিংবা ঘুরিয়ে বলত।
আমি আশাপ্রদ ভাষায় উত্তর দিলুম, 'না, এখনো হয় নি।'
অচিরার কাছে কোনো কথা এড়ায় না। সে বললে,'ঐ এখনো শব্দটা সংশয়গ্রস্ত কন্যাকর্তাদের মনকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে, ওর কোনো যথার্থ অর্থ নেই।'
'একেবারেই নেই নিশ্চিত ঠাওরলেন কী করে।'
'ওটা গণিতের প্রব্লেম, সেও হাইয়ার ম্যাথ্ম্যাটিক্স্ নয়। পূর্বেই শোনা গেছে আপনি ছত্রিশ বছরের ছেলেমানুষ। হিসেব করে দেখলুম এর মধ্যে আপনার মা অন্তত পাঁচসাতবার বলেছেন,'বাবা ঘরে বউ আনতে চাই। ' আপনি জবাব করেছেন, 'তার পূর্বে ব্যাঙ্কে টাকা আনতে চাই।' মা চোখের জল মুছে চুপ করে রইলেন, তার পরে মাঝখানে আপনার আর-সব ঘটেছিল কেবল ফাঁসি ছিল বাকি। শেষকালে এখানকার রাজসরকারের মোটা মাইনের কাজ জুটল। মা বললেন, 'এইবার বউ নিয়ে এসো ঘরে। বড়ো কাজ পেয়েছে।' আপনি বললেন, 'বিয়ে করে সে কাজ মাটি করতে পারব না।' আপনার ছত্রিশ বছরের গণিতফল গণনা করতে ভুল হয়েছে কি না বলুন।'
এ মেয়ের সঙ্গে অনবধানে কথা বলা নিরাপদ নয়। কিছুদিন আগেই আমার একটা পরীক্ষা হয়ে গেছে। কথায় কথায় অচিরা আমাকে বলেছিল, 'আমাদের দেশের মেয়েরা আপনাদের সংসারের সঙ্গিনী হতে পারে কিন্তু বিলেতে যারা জ্ঞানের তাপস তাদের তপস্যার সঙ্গিনী তো জোটে, যেমন ছিলেন অধ্যাপক কুরির সধর্মিণী মাদাম কুরি। আপনার কি তেমন কেউ জোটে নি।'
মনে পড়ে গেল ক্যাথারিনকে। সে একইকালে আমার বিজ্ঞানের এবং জীবনযাত্রার সাহচর্য করতে চেয়েছিল।
অচিরা জিগ্গেসা করলে, 'আপনি কেন তাঁকে বিয়ে করতে চাইলেন না।'
কী উত্তর দেব ভাবছিলুম, অচিরা বললে, 'আমি জানি কেন। আপনার সত্যভঙ্গহবে এই ভয় ছিল; নিজেকে আপনার মুক্ত রাখতেই হবে। আপনি যে সাধক। আপনি তাই নিষ্ঠুর, নিষ্ঠুর নিজের প্রতি, নিষ্ঠুর তার 'পরে যে আপনার পথের সামনে আসে। এই নিষ্ঠুরতায় আপনার বীরত্ব দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত।'
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার সে বললে, 'বাংলাসাহিত্য বোধ হয় আপনি পড়েন না। কচ ও দেবযানী ব'লে একটা কবিতা আছে। তার শেষ কথাটা এই, মেয়েদের ব্রত পুরুষকে বাঁধা, আর পুরুষের ব্রত মেয়ের বাঁধন কাটায়ে স্বর্গলোকের রাস্তা বানানো। কচ বেরিয়ে পড়েছিল দেবযানীর অনুরোধ এড়িয়ে, আর আপনি মায়ের অনুনয়-- একই কথা।'
আমি বললুম, 'দেখুন, আমি হয়তো ভুল করেছিলুম। মেয়েদের নিয়ে পুরুষের কাজ যদি না চলে তা হলে মেয়েদের সৃষ্টি কেন।'
অচিরা বললে, 'বারো-আনার চলে, মেয়েরা তাদের জন্যেই। কিন্তু বাকি মাইনরিটি যারা সব-কিছু পেরিয়ে নতুন পথের সন্ধানে বেরিয়েছে তাদের চলে না। সব-পেরোবার মানুষকে মেয়েরা যেন চোখের জল ফেলে রাস্তা ছেড়ে দেয়। যে দুর্গম পথে মেয়েপুরুষের চিরকালের দ্বন্দ্ব সেখানে পুরুষেরা হোক জয়ী। যে মেয়েরা মেয়েলি, প্রকৃতির বিধানে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি, তারা ছেলে মানুষ করে, সেবা করে ঘরের লোকের। যে পুরুষ যথার্থ পুরুষ, তাদের সংখ্যা খুব কম; তারা অভিব্যক্তির শেষ কোঠায়। মাথা তুলছে দুটি-একটি করে। মেয়েরা তাদের ভয় পায়, বুঝতে পারে না, টেনে আনতে চায় নিজের অধিকারের গণ্ডিতে । এই তত্ত্ব শুনেছি আমার দাদুর কাছে।'
'দাদু, তোমার পড়া রেখে আমার কথা শোনো। মনে আছে, তুমি একদিন বলেছিলে, পুরুষ যেখানে অসাধরণ সেখানে সে নিরতিশয় একলা, নিদারুণ তার নিঃসঙ্গতা, কেননা, তাকে যেতে হয় যেখানে কেউ পৌঁছয় নি। আমার ডায়ারিতে লেখা আছে।'
অধ্যাপক মনে করবার চেষ্টা করে বললেন, 'বলেছিলুম নাকি? হয়তো বলেছিলুম।'
অচিরা খুব বড়ো কথাও কয় হাসির ছলে, আজ সে অত্যন্ত গম্ভীর।
খানিক বাদে আবার সে বললে, 'দেবযানী কচকে কী অভিসম্পাত দিয়েছিল জানেন?'
'না।'
'বলেছিল, 'তোমার সাধনায় পাওয়া বিদ্যা তোমার নিজের ব্যবহারে লাগাতেপারবে না।' যদি এই অভিসম্পাত আজ দেবতা য়ুরোপকে, তা হলে য়ুরোপ বেঁচে যেত। বিশ্বের জিনিসকে নিজের মাপে ছোটো করেই ওখানকার মানুষ মরছে লোভের তাড়ায়। সত্যি কি না বলো দাদু।'
'খুব সত্যি, কিন্তু এত কথা কী করে ভাবলে।'
'নিজের বুদ্ধিতে না। একটা তোমার মহদ্গুণ আছে, কখন কাকে কী যে বল, ভোলানাথ তুমি সব ভুলে যাও। তাই চোরাই মালের উপর নিজের ছাপ লাগিয়ে দিতে ভাবনা থাকে না।'
আমি বললুম, 'নিজের ছাপ যদি লাগে তা হলেই অপরাধ খণ্ডন হয়।'
'জানেন, নবীনবাবু, ওঁর কত ছাত্র ওঁর কত মুখের কথা খাতায় টুকে নিয়ে বই লিখে নাম করেছে। উনি তাই পড়ে আশ্চর্য হয়ে প্রশংসা করেছেন, বুঝতেই পারেন নি নিজের প্রশংসা নিজেই করছেন। কোন্ কথা আমার কথা আর কোন্ কথা ওঁর নিজের সে ওঁর মনে থাকে না-- লোকের সামনে আমাকে বলে বসেন ওরিজিন্যাল, তখন সেটার প্রতিবাদ করার মতো মনের জোর পাওয়া যায় না। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি নবীনবাবুরও এ ভ্রম ঘটছে। কী করবো বলো, আমি তো কোটেশন মার্কা দিয়ে দিয়ে কথা বলতে পারি নে।'
'নবীনবাবুর এ ভ্রম কোনোদিন ঘুচবে না।'
অচিরা বললে, 'দাদু একদিন আমাদের কলেজ-ক্লাসে কচ ও দেবযানীর ব্যাখ্যা করছিলেন। কচ হচ্ছে পুরুষের প্রতীক, আর দেবযানী মেয়ের। সেই দিন নির্মম পুরুষের মহৎ গৌরব মনে মনে মেনেছি, মুখে কক্খনো স্বীকার করি নে।'
অধ্যাপক বললেন, 'কিন্তু দিদি, আমার কোনো কথায় মেয়েদের গৌরবের আমি কোনোদিন লাঘব করি নি।'
'তুমি আবার করবে। হায় রে। মেয়েদের তুমি যে অন্ধ ভক্ত। তোমার মুখের স্তবগান শুনে মনে মনে হাসি। মেয়েরা নির্লজ্জ হয়ে সব মেনে নেয়। তার উপরেও বুক ফুলিয়ে সতীসধ্বীগিরির বড়াই করে নিজের মুখে। সস্তায় প্রশংসা আত্মসাৎ করা ওদের অভ্যেস হয়ে গেছে।
অধ্যাপক বলেলেন, 'না দিদি, অবিচার কোরো না। অনেক কাল ওরা হীনতা সহ্য করেছে, হয়তো সেইজন্যেই নিজেদের শ্রেষ্ঠতা নিয়ে একটু বেশি জোর দিয়ে তর্ক করে।'
'না, দাদু, ও তোমার বাজে কথা। আসল হচ্ছে এটা স্ত্রীদেবতার দেশ-- এখানে পুরুষেরা, স্ত্রৈণ মেয়েরাও স্ত্রৈণ। এখানে পুরুষরা কেবলই 'মা মা' করছে, আর মেয়েরাচিরশিশুদের আশ্বাস দিচ্ছে যে তারা মায়ের জাত। আমার তো লজ্জা করে। পশু পক্ষীদের মধ্যেও মায়ের জাত নেই কোথায়?'
চিত্তচাঞ্চল্যে কাজের এত বাধা ঘটছে যে লজ্জা পাচ্ছি মনে মনে। সদরে বাজেটের মিটিঙে রিসর্চবিভাগে আরো কিছু দান মঞ্জুর করিয়ে নেবার প্রস্তাব ছিল। তার সমর্থক রিপোর্টখানা অর্ধেকের বেশি লেখাই হয় নি। অথচ এদিকে ক্রোচের এস্থেটিক্স্ নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা শুনে আসছি। অচিরা নিশ্চিত জানে বিষয়টা আমার উপলব্ধি ও উপভোগের সম্পূর্ণ বাইরে। তা হলেও চলত, কিন্তু আমার বিশ্বাস ব্যাপারটাকে সে ইচ্ছে করে শোচনীয় করে তুলেছে। ঠিক এই সময়টাতেই সাঁওতালদের পার্বণ। তারা পচাই মদ খাচ্ছে আর মাদল বাজিয়ে মেয়েপুরুষে নৃত্য করছে। অচিরা ওদের পরম বন্ধু। মদের পয়সা জোগায়, সালু কিনে দেয় সাঁওতাল ছেলেদের কোমরে বাঁধবার জন্যে, বাগান থেকে জবাফুলের জোগান দেয় সাঁওতাল মেয়েদের চুলে পরবার। ওকে না হলে তাদের চলেই না। অচিরা অধ্যাপককে বলেছে, ও তো এ কদিন থাকতে পারবে না অতএব এই সময়টাতে বিরলে আমাকে নিয়ে ক্রোচের রসতত্ত্ব যদি পড়ে শোনান তা হলে আমার সময় আনন্দে কাটবে। একবার সসংকোচে বলেছিলুম, 'সাঁওতালদের উৎসব দেখতে আমার বিশেষ কৌতূহল আছে।' স্বয়ং অধ্যাপক বললেন, না, সে আপনার ভালো লাগবে না। আমার ইনটেলেক্চুয়ল মনোবৃত্তির নির্জলা একান্ততার 'পরে তাঁর এত বিশ্বাস। মধ্যাহ্নভোজনের পরেই অধ্যাপক গুন গুন করে পড়ে চলেছেন। দূরে মাদলের আওয়াজ এক-একবার থামছে। পরক্ষণেই দ্বিগুণ জোরে বেজে উঠছে। কখনো বা পদশব্দ কল্পনা করছি, কখনো বা হতাশ হয়ে ভাবছি অসমাপ্ত রিপোর্টের কথা। সুবিধে এই অধ্যাপক জিগ্গেসাই করেন না কোথাও আমার ঠেকছে কিনা। তিনি ভাবেন সমস্তই জলের মতো সোজা। মাঝে মাঝে প্রতিবাদ উপলক্ষে প্রশ্ন করেন, আপনারও কি এই মনে হয় না। আমি খুব জোরের সঙ্গে বলি নিশ্চয়।
ইতিমধ্যে কিছুদূরে আমাদের অর্ধসমাপ্ত কয়লার খনিতে মজুরদের হল স্ট্রাইক। ঘটালেন যিনি, এই তাঁর ব্যাবসা, স্বভাব এবং অভাব বশত; সমস্ত কাজের মধ্যে এইটেই সব চেয়ে সহজ। কোনো কারণ ছিল না, কেননা আমি নিজে সোশালিস্ট, সেখানকার বিধিবিধান আমার নিজের হাতে বাঁধা, কারো সেখানে না ছিল লোকসান, না ছিল অসম্মান।
নূতন যন্ত্র এসেছে জর্মনি থেকে, তারই খাটাবার চেষ্টায় ব্যস্ত আছি। এমনসময় উত্তেজিত ভাবে এসে উপস্থিত অচিরা। বললে, 'আপনি মোটা মাইনে নিয়ে ধনিকের নায়েবি করছেন, এদিকে গরিবের দারিদ্র৻ের সুযোগটাকে নিয়ে আপনি--'
চন্ করে উঠল মাথা। বাধা দিয়ে বললুম,কাজ চালাবার দায়িত্ব এবং ক্ষমতা যাদের তারাই অন্যায়কারী, আর জগতে যারা কোনো কাজই করে না, করতে পারেও না, দয়ামায়া কেবল তাদেরই-- এই সহজ অহংকারের মত্ততায় সত্যমিথ্যার প্রমাণ নিতেও মন চায় না।'
অচিরা বললে, 'সত্য নয় বলতে চান?'
আমি বললুম, 'সত্য শব্দটা আপেক্ষিক। যা কিছু যত ভালোই হোক, তার চেয়ে আরো ভালো হতেও পারে। এই দেখুন-না আমার মোটা মাইনে বটে, তার থেকে মাকে পাঠাই পঞ্চাশ, নিজে রাখি ত্রিশ, আর বাকি-- সে হিসেবটা থাক্। কিন্তু মার জন্যে পনেরো নিজের জন্যে পাঁচ রাখলে আইডিয়ালের আরো কাছ ঘেঁষে যেত, কিন্তু একটা সীমা আছে তো।'
অচিরা বললে, 'সীমাটা কি নিজের ইচ্ছের উপরেই নির্ভর করে।'
আমি বললুম, 'না, অবস্থার উপরে। যে কথাটা উঠল সেটা একটু বিচার করে দেখুন। য়ুরোপে ইণ্ডস্ট্রীয়ালিজ্ম্ গড়ে উঠেছে দীর্ঘকাল ধরে। যাদের হাতে টাকা ছিল এবং টাকা করবার প্রতিভা ছিল তারাই এটা গড়েছে। গড়েছে নিছক টাকার লোভে, সেটা ভালো নয় তা মানি। কিন্তু ঐ ঘুষটুকু যদি না পেত তা হলে একেবারে গড়াই হত না, এতদিন পরে আজ ওখানে পড়েছে হিসেবনিকেশের তলব।'
অচিরা বললে, 'আপনি বলতে চান পায়ে তেল শুরুতে, কানমলা তার পরে?'
'নিশ্চয়। আমাদের দেশে ভিত-গাঁথা সবে আরম্ভ হয়েছে এখনই যদি মার লাগাই তা হলে শুরুতেই হবে শেষ, সুবিধে হবে বিদেশী বণিকদের। মানছি আজ আমি লোভীদের ঘুষ দেওয়ার কাজ নিয়েছি, টাকাওয়ালার নায়েবি আমি করি। আজ সেলাম করছি বাদশার দরবারে এসে, কাল ওদের সিংহাসনের পায়ায় লাগাব কুড়ুল। ইতিহাসে তো এই দেখা গেছে।
অচিরা বললে, 'সব বুঝলুম। কিন্তু আমি দিনের পর দিন অপেক্ষা করে আছি দেখতে, এই স্ট্রাইক মেটাতে আপনি নিজে কবে যাবেন। নিশ্চয়ই আপনাকে ডাকাও পড়েছিল। কিন্তু কেন যান নি?'
চাপা গলায় বলতে চেষ্টা করলুম, 'এখানে কাজ ছিল বিস্তর।' কিন্তু ফাঁকি দেব কী করে। আমার ব্যবহারে তো আমার কৈফিয়তের প্রমাণ হয় না।
কঠিন হাসি হেসে দ্রুতপদে চলে গেল অচিরা।
আর চলবে না। একটা শেষ নিষ্পত্তি করাই চাই। নইলে অপমানের অন্ত থাকবে না।
সাঁওতালী পার্বণ শেষ হয়েছে। সকালে বেড়াতে বেরিয়েছি। অচিরা সঙ্গে ছিল। উত্তরের দিকে একটা পাহাড় উঠেছে, আকাশের নীলের চেয়ে ঘন নীল। তার গায়ে গায়ে চারা শাল আর বৃদ্ধ শাল গাছে বন অন্ধকার। মাঝখান দিয়ে কাঠুরেদের পায়ে-চলার পথ। অধ্যাপক একটা অর্কিড ফুল বিশেষ করে পর্যবেক্ষণ করছেন, তাঁর পকেটে সর্বদা থাকে আতস কাচ।
গাছগুলোর মধ্যে অন্ধকার যেখানে ভ্রূকুটিল হয়ে উঠেছে আর ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে তীব্র আওয়াজে, অচিরা বসল একটা শেওলাঢাকা পাথরের উপর। পাশে ছিল মোটা জাতের বাঁশগাছ, তারই ছাঁটা কঞ্চির উপর আমি বসলুম। আজ সকাল থেকে অচিরার মুখে বেশি কথা ছিল না। সেইজন্যেই তার সঙ্গে আমার কথা কওয়া বাধা পাচ্ছিল।
সামনের দিকে তাকিয়ে এক সময় সে আস্তে আস্তে বলে উঠল, 'সমস্ত বনটা মিলে প্রকাণ্ড একটা বহুঅঙ্গওয়ালা প্রাণী। গুঁড়ি মেরে বসে আছে শিকারি জন্তুর মতো। যেন স্থলচর অক্টোপাশ, কালো চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার নিরন্তর হিপনটিজমে ক্রমে ক্রমে দিনে দিনে আমার মনের মধ্যে একটা ভয়ের বোঝা যেন নিরেট হয়ে উঠ্ছে।'
আমি বললুম, 'কতকটা এইরকম কথাই এই সেদিন আমার ডায়ারিতে লিখেছি।'
অচিরা বলে চলল, 'মনটা যেন পুরোনো ইমারত, সকল কাজের বার। নিষ্ঠুর অরণ্য যেখানে পেয়েছে তার ফাটল, চালিয়ে দিয়েছে শিকড়, সমস্ত ভিতরটাকে টানছে ভাঙনের দিকে। এই বোবা কালা মহাকায় জন্তু মনের ফাটল আবিষ্কার করতে মজবুত-- আমার ভয় বেড়ে চলেছে। দাদু বলেছিলেন, 'লোকালয় থেকে একান্ত দূরে থাকলে মানুষের মনঃপ্রকৃতি আসে অবশ হয়ে, প্রবল হয়ে ওঠে তার প্রাণপ্রকৃতি।' আমি জিগ্গেস করলুম, 'এর প্রতিকার কী।' তিনি বললেন, 'মানুষের মনের শক্তিকে আমরা সঙ্গে করে আনতে পারি, এই দেখো-না এনেছি তাকে আমার লাইব্রেরিতে। দাদুর উপযুক্ত এই উত্তর। কিন্তু আপনি কী বলেন।'
আমি বললুম, 'আমাদের মন খোঁজে এমন একজন মানুষের সঙ্গ যে আমাদের সমস্ত অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ জাগিয়ে রাখতে পারে, চেতনার বন্যা বইয়ে দেয় জনশূন্যতার মধ্যে। এ তো লাইব্রেরির সাধ্য নয়।'
অচিরা একটু অবজ্ঞা করে বললে, 'আপনি যার খোঁজ করছেন তেমন মানুষ পাওয়া যায় বৈকি, যদি বড্ড দরকার পড়ে। তারা চৈতন্যকে উসকিয়ে তোলে নিজের দিকেই, বন্যা বইয়ে দিয়ে সাধনার বাঁধ ভেঙে ফেলে। এ-সমস্তই কবিদের বানানো কথা, মোহরস দিয়ে জারানো। আপনাদের মতো বুকের-পাটাওয়ালা লোকের মুখে মানায় না। প্রথম যখন আপনাকে দেখেছিলুম, তখন দেখেছি আপনি রস খুঁজে বেড়ান নি, পথ খুঁড়ে বেড়িয়েছিলেন কড়া মাটি ভেঙে। দেখেছি আপনার নিরাসক্ত পৌরুষের মুর্তি-- সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে আপনাকে প্রণাম করেছি। আজ আপনি কথার পুতুল দিয়ে নিজেকে ভোলাতে বসেছেন। এ দশা ঘটালে কে। স্পষ্ট করেই জিজ্ঞাসা করি, এর কারণ কি আমি।'
আমি বললুম, 'তা হতে পারে। কিন্তু আপনি তো সাধারণ মেয়ে নন। পুরুষকে আপনি শক্তি দেবেন।'
'হাঁ, শক্তি দেব, যদি নিজেকেই মোহ জড়িয়ে না ধরে। আভাসে বুঝেছি আপনি আমার ইতিহাস কিছু কিছু সংগ্রহ করেছেন। আপনার কাছে কিছু ঢাকবার দরকার নেই॥ আপনি শুনেছেন আমি ভবতোষকে ভালোবেসেছিলুম।'
'হাঁ শুনেছি।'
'এও জানেন আমার ভালোবাসার অপমান ঘটেছে।'
'হাঁ জানি।'
'সেই অপমানিত ভালোবাসা অনেকদিন ধরে আমাকে আঁকড়ে ধরে দুর্বল করেছে। আমি জেদ করে বসেছিলুম তারই একনিষ্ঠ স্মৃতিকে জীবনের পূজামন্দিরে বসাব। চিরদিন একমনে সেই নিষ্ফল সাধনা করব মেয়েরা যাকে বলে সতীত্ব। নিজের ভালোবাসার অহংকারে সংসারকে ঠেলে ফেলে নির্জনে চলে এসেছি। কর্তব্যকে অবজ্ঞা করেছি নিজের দুঃখকে সম্মান করব ব'লে। আমার দাদুকে অনায়াসে সরিয়ে এনেছি তাঁর কাজের ক্ষেত্র থেকে। যেন এই মেয়েটার হৃদয়ের অহমিকা পৃথিবীর সব-কিছুর উপরে। মোহ, মোহ, অন্ধ মোহ।'
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ সে বলে উঠল, 'জানেন আপনিই সেই মোহ ভাঙিয়ে দিয়েছেন।'
বিস্মিত হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলুম। সে বললে, 'আপনিই এই আত্মাবমাননা থেকে ছিনিয়ে এনে আমাকে বাঁচালেন।'
স্তব্ধ রইলুম নিরুত্তর প্রশ্ন নিয়ে।
'আপনি তখনো আমাকে দেখেন নি। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখেছি আপনার দুঃসাধ্য প্রয়াসের দিনগুলি-- সঙ্গ নেই, আরাম নেই, ক্লান্তি নেই, একটু কোথাও ছিদ্র নেই অধ্যবসায়ে। দেখেছি আপনার প্রশস্ত ললাট, আপনার চাপা ঠোঁটে অপরাজেয় ইচ্ছাশক্তির লক্ষণ, আর দেখেছি মানুষকে কী রকম অনায়াসে প্রভুত্বের জোরে চালনা করেন। দাদুর কাছে আমি মানুষ, আমি পুরুষের ভক্ত, যে পুরুষ সত্য যে পুরুষ তপস্বী। সেই পুরুষকেই দেখবার জন্যে আমার ভক্তিপিপাসু নারী ভিতরে ভিতরে অপেক্ষা করে ছিল নিজের অগোচরে। মাঝখানে এসেছিল অপদেবতা প্রবৃত্তির টানে। অবশেষে নিষ্কাম পুরুষের সুদৃঢ় শক্তিরূপ আপনিই আনলেন আমার চোখের সামনে।
আমি জিগ্গেসা করলুম, 'তার পর কি ভাবের পরিবর্তন হয়েছে।'
'হাঁ হয়েছে। আপনার বেদী থেকে নেমে এসেছেন প্রতিদিন। স্থানীয় কাগজে পড়লুম, দূরে অন্য-এক জায়গায় সন্ধানের কাজে আপনার ডাক পড়েছে। আপনি নড়লেন না, ভিতরে ভিতরে আত্মগ্লানি ভোগ করলেন। আপনার পথের সামনেকার ঢেলাখানার মতো আমাকে লাথি মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন না কেন। কেন নিষ্ঠুর হতে পারলেন না। যদি পারতেন তবে আমি ধন্য হতুম। আমার ব্রতের পারণা হত আমার কান্না দিয়ে।'
মৃদুস্বরে বললুম, 'যাবার জন্যেই কাগজপত্তর গুছিয়ে নিচ্ছিলুম।'
'না, না, কখনোই না। মিথ্যে ছুতো করে নিজেকে ভোলাচ্ছিলেন। যতই দেখলুম আপনার দুর্বলতা, ভয় হতে লাগল আমার নিজেকে নিয়ে। ছি, ছি, কী পরাভবের বিষ এনেছি নারীর জীবনে, কেবল অন্যের জন্যে নয়, নিজের জন্যেও। ক্রমশই একটা চাঞ্চল্য আমাকে পেয়ে বসল, সে যেন এই বনের বিষনিশ্বাস থেকে । একদিন এখানকার পিশাচী রাত্রি এমন আমাকে আবিষ্ট করে ধরেছিল যে মনে হল যে এত বড়ো প্রবৃত্তি রাক্ষসীও আছে যে আমার দাদুর কাছ থেকেও আমাকে ছিনিয়ে নিতে পারে। তখনই সেই রাত্রেই ছুটে নদীর জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে ডুব দিয়ে দিয়ে স্নান করে এসেছি।
এই কথা বলতে বলতে অচিরা ডাক দিল, 'দাদু।'
অধ্যাপক গাছতলায় বসে পড়ছিলেন। উঠে এসে স্নেহের স্বরে বললেন, 'কী দিদি? দূর থেকে বসে বসে ভাবছিলুম, তোমার উপরে আজ বাণী ভর দিয়েছেন-- জ্বল জ্বল করছে তোমার চোখ দুটি।'
'আমার কথা থাক্, তুমি শোনো। তুমি সেদিন বলেছিলে মানুষের চরম অভিব্যক্তি তপস্যার মধ্য দিয়ে।'
'হাঁ, আমি তাই তো বলি। বর্বর মানুষ জন্তুর পর্যায়ে। কেবলমাত্র তপস্যার মধ্য দিয়ে সে হয়েছে জ্ঞানী মানুষ। আরো তপস্যা আছে সামনে, স্থূল আবরণ যুগে যুগে ত্যাগ করতে করতে সে হবে দেবতা। পুরাণে দেবতার কল্পনা আছে, কিন্তু দেবতা ছিলেন না অতীতে, দেবতা আছেন ভবিষ্যতে। মানুষের ইতিহাসের শেষ অধ্যায়ে।'
অচিরা বললে, 'দাদু, এইবার এসো, তোমার-আমার কথাটা আপসে চুকিয়ে দিই, কদিন থেকে মনের মধ্যে তোলপাড় করছে।'
আমি উঠে পড়লুম, বললুম, 'তা হলে যাই।'
'না, আপনি বসুন।-- দাদু, সেই যে কলেজের অধ্যক্ষপদটা তোমার ছিল, সেটা খালি হয়েছে। তোমাকে ডাক দিয়েছে ওরা।'
অধ্যাপক আশ্চর্য হয়ে বললেন, 'কী করে জানলে ভাই।'
'তোমার কাছে চিঠি এসেছে, সে আমি চুরি করেছি।'
'চুরি করেছ!'
'করব না! আমাকে সব চিঠিই দেখাও কেবল কলেজের ছাপ-মারা ঐ চিঠিটাই দেখালে না। তোমার দুরভিসন্ধি সন্দেহ করে চুরি করে দেখতে হল।'
অধ্যাপক অপরাধীর মতো ব্যস্ত হয়ে বললেন, 'আমারই অন্যায় হয়েছে।'
'কিছু অন্যায় হয় নি। আমাকে লুকোতে চেয়েছিলে যে আমার জীবনের অভিসম্পাত এখনো তুমি নিজের উপর টেনে নিয়ে চলবে। তোমার আপন আসন থেকে আমি যে নামিয়ে এনেছি তোমাকে। আমাদের তো ঐ কাজ।'
'কী বলছ দিদি।'
'সত্যি কথাই বলছি। তুমি শিক্ষাদানযজ্ঞের হোতা, এখানে এনে আমি তোমাকে করেছি শুধু গ্রন্থকীট। বিশ্বসৃষ্টি বাদ দিলে কী দশা হয় বিশ্বকর্তার। ছাত্র না থাকলে তোমার হয় ঠিক তেমনি। সত্যি কথা বলো।'
'বরাবর ইস্কুলমাস্টারি করে এসেছি কিনা।'
'তুমি আবার ইস্কুলমাস্টার! কী যে বল তুমি! তুমি যে স্বভাবতই আচার্য। দেখেন নি, নবীনবাবু, ওঁর মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে কি আর দয়ামায়া থাকে না। অমনি আমাকে নিয়ে পড়েন-- বারো-আনাই বুঝতেই পারি না। নইলে হাতড়িয়ে বের করেন এই নবীনবাবুকে, সে হয় আরো শোচনীয়। দাদু, ছাত্র তোমার নিতান্তই চাই জানি, কিন্তু বাছাই করে নিয়ো, রূপকথার রাজা সকালে ঘুম থেকে উঠেই যার মুখ দেখত তাকেই কন্যা দান করত। তোমার বিদ্যাদান অনেকটা সেই রকম।'
'না দিদি, আমাকে বাছাই করে নেয় যারা তারাই সাহায্য পায় আমার। এখনকার দিনে কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞাপন দিয়ে ছাত্র সংগ্রহ করে, আগেকার দিনে সন্ধান করে শিক্ষক লাভ করত শিক্ষার্থী।'
'আচ্ছা, সে কথা পরে হবে। এখনকার সিদ্ধান্ত এই যে, তোমাকে তোমার সেই কাজটা ফিরিয়ে নিতে হবে।'
অধ্যাপক হতবুদ্ধির মতো নাতনির মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। অচিরা বললে, 'তুমি ভাবছ, আমার গতি কী হবে। আমার গতি তুমি। আর আমাকে ছাড়লে তোমার কী গতি জানই তো। এখন যে তোমার পনেরোই আশ্বিনে পনেরোই অক্টোবরে এক হয়ে যায়, নিজের নূতন ছাতার সঙ্গে পরের পুরোনো ছাতার স্বত্বাধিকারে ভেদজ্ঞান থাকে না, গাড়ি চড়ে ড্রাইভারকে এমন ঠিকানা বাতলিয়ে দাও সেই ঠিকানায় আজ পর্যন্ত কোনো বাড়ি তৈরি হয় নি, আর চাকরের ঘুম ভাঙবার ভয়ে সাবধানে পা টিপে টিপে কলতলায় নিজে গিয়ে কুঁজোয় জল ভরে নিয়ে আস।'
অধ্যাপক আমার দিকে চেয়ে বললেন, 'কী তুমি বল, নবীন।'
কী জানি ওঁর হয়তো মনে হয়েছিল ওঁদের এই পারিবারিক প্রস্তাবে আমার ভোটেরও একটা মুল্য আছে।
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে রইলুম, তার পরে বললুম 'অচিরাদেবীর চেয়ে সত্য পরামর্শ আপনাকে কেউ দিতে পারবে না।'
অচিরা তখনই উঠে দাঁড়িয়ে পা ছুঁয়ে আমাকে প্রণাম করলে। বোধ হল যেন চোখ থেকে জল পড়ল আমার পায়ে। আমি সংকুচিত হয়ে পিছু হটে গেলুম।
অচিরা বললে, 'সংকোচ করবেন না। আপনার তুলনায় আমি কিছুই নই সে কথা নিশ্চয় জানবেন। এই কিন্তু শেষ বিদায়, যাবার আগে আর দেখা হবে না।'
অধ্যাপক বিস্মিত হয়ে বললেন, 'সে কী কথা, দিদি।'
অচিরা বাষ্পগদগদ কন্ঠ সামলিয়ে হেসে বললে, 'দাদু, তুমি অনেক-কিছু জান, কিন্তু আরো-কিছু সম্বন্ধে আমার বুদ্ধি তোমার চেয়ে অনেক বেশি, এ কথাটা মেনে নিয়ো।'
এই বলে চলতে উদ্যত হল। আবার ফিরে এসে বললে, 'আমাকে ভুল বুঝবেন না-- আজ আমার তীব্র আনন্দ হচ্ছে যে আপনাকে মুক্তি দিলুম-- তার থেকে আমারও মুক্তি। আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছে-- লুকোব না, জল আরো পড়বে। নারীর চোখের জল তাঁরই সম্মানে যিনি সব বন্ধন কাটিয়ে জয়যাত্রায় বেরিয়েছেন।
দ্রুতপদে অচিরা চলে গেল।
আমি পদধূলি নিয়ে প্রণাম করলুম অধ্যাপককে। তিনি আমাকে বুকে চেপে ধরে বললেন, 'আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমার সামনে কীর্তির পথ প্রশস্ত।'
ছোটো গল্প ফুরল। পরেকার কথাটা খনি-খোঁড়ার ব্যাপার নিয়ে। তারও পরে আরো বাকি আছে-- সে ইতিহাস নিরতিশয় একলার অভিযান, জনতার মাঝখান দিয়ে দুর্গম পথে রুদ্ধ দুর্গের দ্বার-অভিমুখে।
বাড়ি ফিরে গিয়ে যত আমার প্ল্যান আর নোট আর রেকর্ড উলটে পালটে নাড়াচাড়া করলুম। দেখলুম, সামনে দিগন্তবিস্তৃত কাজের ক্ষেত্র তাতেই আমার বৃহৎ ছুটি।
সন্ধেবেলায় বারান্দায় এসে বসলুম। খাঁচা ভেঙে গেছে। পাখির পায়ে আটকে রইল ছিন্ন শিকল। সেটা নড়তে চড়তে পায়ে বাজবে।