বাবার মাথায় বরফের পুঁটুলি বুলোতে বুলোতে কুমুদিনী বলে, "মারবে কেন বাবা? ঝড় হচ্ছে; এখনই থেমে যাবে।"
"বৃন্দাবন? বৃন্দাবন... চন্দ... চক্রবর্তী! বাবার আমলের পুরুত-- সে তো মরে গেছে--ভূত হয়ে গেছে বৃন্দাবনে। কে বললে সে আসবে?"
"কথা কোয়ো না বাবা, একটু ঘুমোও।"
"ঐ যে, কাকে বলছে, খবরদার, খবরদার!"
"কিছু না, বাতাসে বাতাসে গাছগুলোকে ঝাঁকানি দিচ্ছে।"
"কেন, ওর রাগ কিসের? এতই কী দোষ করেছি, তুই বল্ মা।"
"কোনো দোষ কর নি বাবা। একটু ঘুমোও।"
"বিন্দে দূতী? সেই যে মধু অধিকারী সাজত।
মিছে কর কেন নিন্দে,
ওগো বিন্দে শ্রীগোবিন্দে--"
চোখ বুজে গুন্ গুন্ করে গাইতে লাগলেন।
"কার বাঁশি ওই বাজে বৃন্দাবনে।
সই লো সই,
ঘরে আমি রইব কেমনে!
রাধু, ব্র৻ান্ডি লে আও।"
কুমুদিনী বাবার মুখের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে, "বাবা, ও কী বলছ?" মুকুন্দলাল চোখ চেয়ে তাকিয়েই জিভ কেটে চুপ করেন। বুদ্ধি যখন অত্যন্ত বেঠিক তখনো এ কথা ভোলেন নি যে, কুমুদিনীর সামনে মদ চলতে পারে না।
একটু পরে আবার গান ধরলেন,
"শ্যামের বাঁশি কাড়তে হবে,
নইলে আমায় এ বৃন্দাবন ছাড়তে হবে।"
এই এলোমেলো গানের টুকরোগুলো শুনে কুমুর বুক ফেটে যায়-- মায়ের উপর রাগ করে, বাবার পায়ের তলায় মাথা রাখে যেন মায়ের হয়ে মাপ-চাওয়া।
মুকুন্দ হঠাৎ ডেকে উঠলেন, "দেওয়ানজি?"
দেওয়ানজি আসতে তাকে বললেন, "ঐ যেন ঠক্ ঠক্ শুনতে পাচ্ছি।"
দেওয়ানজি বললেন, "বাতাসে দরজা নাড়া দিচ্ছে।"
"বুড়ো এসেছে, সেই বৃন্দাবনচন্দ্র-- টাক মাথায়, লাঠি হাতে, চেলির চাদর কাঁধে। দেশে এসো তো। কেবলই ঠক্ ঠক্ ঠক্ ঠক্ করছে। লাঠি, না খড়ম?"
রক্তবমন কিছুক্ষণ শান্ত ছিল। তিনটে রাত্রে আবার অরাম্ভ হল। মুকুন্দলাল বিছানার চারি দিকে হাত বুলিয়ে জড়িতস্বরে বললেন, "বড়োবউ, ঘর যে অন্ধকার! এখনো আলো জ্বালবে না?"
বজরা থেকে ফিরে আসবার পর মুকুন্দলাল এই প্রথম স্ত্রীকে সম্ভাষণ করলেন-- আর এই শেষ।
বৃন্দাবন থেকে ফিরে এসে নন্দরানী বাড়ির দরজার কাছে মূর্ছিত হয়ে লুটিয়ে পড়লেন। তাঁকে ধরাধরি করে বিছানায় এনে শোয়াল। সংসারে কিছুই তাঁর আর রুচল না। চোখের জল একেবারে শুকিয়ে গেল। ছেলেমেয়েদের মধ্যেও সান্ত্বনা নেই। গুরু এসে শাস্ত্রের শ্লোক আওড়ালেন, মুখ ফিরিয়ে রইলেন। হাতের লোহা খুললেন না-- বললেন, "আমার হাত দেখে বলেছিল আমার এয়োত ক্ষয় হবে না। সে কি মিথ্যে হতে পারে?"
দূরসম্পর্কের ক্ষেমা ঠাকুরঝি আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, "যা হবার তা তো হয়েছে, এখন ঘরের দিকে তাকাও। কর্তা যে যাবার সময় বলে গেছেন, বড়োবউ ঘরে কি আলো জ্বালবে না?"
নন্দরানী বিছানা থেকে উঠে বসে দূরের দিকে তাকিয়ে বললেন, "যাব, আলো জ্বালতে যাব। এবার আর দেরি হবে না।" বলে তাঁর পাণ্ডুবর্ণ শীর্ণ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেন হাতে প্রদীপ নিয়ে এখনই যাত্রা করে চলেছেন।
সূর্য গেছেন উত্তরায়ণে; মাঘ মাস এল, শুক্ল চতুর্দশী। নন্দরানী কপালে মোটা করে সিঁদুর পরলেন, গায়ে জড়িয়ে নিলেন লাল বেনারসি শাড়ি। সংসারের দিকে না তাকিয়ে মুখে হাসি নিয়ে চলে গেলেন।