(স্বগত)তাই বটে!-- ছেলেবেলা থেকে বরাবর অকারণে কেমন আমার একটা ধারণা ছিল যে, আমি বড়ো কম লোক নই। এত দিনে তার কারণটা বোঝা যাচ্ছে। আর এও দেখেছি ব্রাহ্মণের ঐ পুষ্করিণীটির প্রতি আমার অনেক দিন থেকে লোভ পড়েছিল; থেকে থেকে আমার কেবলই মনে হত, ও পুকুরটা কোনোমতে ঘিরে না নিতে পারলে মেয়েছেলেদের ভারি অসুবিধে হচ্ছে। একেবারে সাফ মনেই ছিল না যে, আমি ভগীরথ, আর মা গঙ্গা এখনো আমাকে ভুলতে পারেন নি। উঃ, সে জন্মে যে তপিস্যেটা করেছিলুম এ জন্মেকার মিথ্যে মকদ্দমাগুলো তার কাছে লাগে কোথায়!

(ভক্তমণ্ডলীর প্রতি ঈষৎ সহাস্যে) তা কি আর আমি জানতেম না! কিন্তু তোমাদের কাছে কিছু ফাঁস করি নি, কী জানি পাছে বিশ্বাস না কর। কলিকালে দেবতা-ব্রাহ্মণের প্রতি তো কারো ভক্তি নেই। তা ভয় নেই, আমি তোমাদের সব অপরাধ মাপ করলুম -- কে গো তুমি? পায়ের ধুলো? তা, এই নাও (পদপ্রসারণ)। তুমি কী চাও গা? পাদোদক? এসো, এসো। নিয়ে এসো তোমার বাটি-- এই নাও-- খেয়ে ফেলো। ভোরবেলা থেকে পাদোদক দিতে দিতে আমার সর্দি হয়ে মাথা ভার হয়ে এল।-- বাছা, তোমরা সব এসো, কিছু ভয় নেই। এতদিন আমাকে চিনতে পারনি সে তো আর তোমাদের দোষ নয়। আমি মনে করেছিলুম কথাটা তোমাদের কাছে প্রকাশ করব না, যেমন চলছে এমনিই চলবে-- তোমরা আমাকে তোমাদের মাধব বক্‌শির ছেলে রুদ্‌দুর বক্‌শি বলেই জানবে। (ঈষৎ হাস্য) কিন্তু মা গঙ্গা যখন স্বয়ং ফাঁস করে দিলেন তখন আর নুকোতে পারলুম না। কথাটা সর্বত্রই রাষ্ট্র হয়ে গেছে। ও আর কিছুতে ঢাকা রইল না। এই দেখো-না হিন্দুপ্রকাশে কী লিখেছে। ওরে তিনকড়ে, চট করে সেই কাগজখানা নিয়ে আয় তো। এই দেখো-- "কলিযুগের ভগীরথ এবং ফজুগঞ্জের ভাগীরথী'-- লোকটার রচনাশক্তি দিব্য আছে। আর সেই পরশুদিনকার বঙ্গতোষিণী-খানা আন্‌ দেখি, তাতেও বড়ো বড়ো দুখানা চিঠি বেরিয়েছে। কী? খুঁজে পাচ্ছিস নে? হারিয়েছিস বুঝি? হারায় যদি তো তোর দুখানা হাড় আস্ত রাখব না, তা জানিস! সেদিন যে তোর হাতে দিয়ে বলে দিলুম আল্মারির ভিতর তুলে রেখে দিস! পাজি বেটা! নচ্ছার বেটা! হারামজাদা বেটা! কোথায় আমার কাগজ হারালি বের করে দে! দে বের করে! যেখান থেকে পাস নিয়ে আয়, নইলে তোকে পুঁতে ফেলব বেটা!-- ওঃ, তাই বটে, আমার ক্যাশব্যাক্সের ভিতরে তুলে রেখেছিলুম। ওহে হরিভূষণ, পড়ে শুনিয়ে দাও তো, আমার আবার বাংলা পড়াটা ভালো অভ্যেস নেই। --কে গা? মতি গয়লানী বুঝি? তা, এসো এসো, আমি পায়ের ধুলো দিচ্ছি-- দুধের দাম নিতে এসেছ? এখনো শোন নি বুঝি? নন্দ মুখুজ্জেকে মা গঙ্গা কি স্বপন দিয়েছেন সে-সব খবর রাখ না? বেটি, তুই আমার পুকুরের জল দুধের সঙ্গে মিশিয়ে আমাকে বিক্রি করেছিস, সে জলের মাহাত্ম্য জানিস? কেমন, সবার কাছে কথাটা শুনলি তো? এখন হিসেবটা রেখে পায়ের ধুলো নিয়ে আমার খিড়কির ঘাটে চট করে একটা ডুব দিয়ে আয় গে যা।

এই এখনই যাচ্ছি। বেলা হয়েছে সে কি আর জানি নে? ভাত ঠাণ্ডা হয়ে গেল? তা, কী করব বলো। লোকজন সব অনেক দূর থেকে একটু পায়ের ধুলোর প্রত্যাশায় এসেছে, এরা কি সব নিরাশ হয়ে যাবে! আচ্ছা, উঠি। ওরে তিনকড়ে, তুই এখানে হাজির থাকিস-- যারা আমাকে দেখতে আসবে সব বসিয়ে রাখিস, আমি এলুম ব'লে। খবরদার! দেখিস যেন কেউ দর্শন না পেয়ে ফিরে না যায়। বলিস ভগীরথ-ঠাকুরের ভোগ হচ্ছে। বুঝলি? আমি দুটো ভাত মুখে দিয়েই এলুম বলে।

রেধো, তুই যে একেবারে সিধে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে রইলি! তোর কি মাথা নোয় না নাকি? তোর তো ভারি অহংকার দেখছি। বেটা, তোর ভক্তির লেশমাত্র নেই। পাজি বেটা, তোকে জুতো মেরে বিদায় করে দেব তা জানিস? সবাই আমাকে ভক্তি করছে, আর তুই বেটা এতবড়ো খ্রীস্টান হয়েছিস যে, আমাকে দেখে প্রণাম করিস নে! তোর পরকালের ভয় নেই? বেরো আমার বাড়ি থেকে।

ছি বাবা উমেশ, তোমার এত বয়স হল, তবু কার সঙ্গে কিরকম ব্যবহার করতে হয় শিখলে না? যে ভগীরথ মর্তে গঙ্গা এনেছিলেন তাঁর গল্প মহাভারতে পড়েছ তো? ভুল করছ-- ঐরাবত নয়, সে ভগীরথ। আমাকে সেই ভগীরথ বলে জেনো। বুঝেছ? মনে থাকবে তো? ভগীরথ, ঐরাবত নয়। সেই জায়গাটা মাস্টারের কাছে পড়ে নিয়ো। এসো বাবা, তোমার মাথায় পায়ের ধুলো দিয়ে দিই।

কই? ভাত কই? আমি আর সবুর করতে পারছি নে-- দেশ-দেশান্তর থেকে সব লোক আসছে। কী গো গিন্নি, এত রাগ কিসের? হয়েছে কী? খিড়কির পুকুরে লোকজনের ভিড় হয়েছে? নাওয়া, কাপড় কাচা, বাসন মাজা, জল তোলা, সমস্ত বন্ধ হয়েছে? কী করব বলো। আমি স্বয়ং ভগীরথ হয়ে গঙ্গা থেকে তো কাউকে ব'ত করতে পারি নে। তা হলে আমি এত তপিস্যে করে এত কষ্ট করে গঙ্গা আনলুম কেন? তোমাদের ময়লা কাপড় কাচবার জন্যে -- বটে! যখন ব্রাহ্মণের সঙ্গে মকদ্দমা করছিলুম তখন তোমরা সেই আশায় বসেছিলে, আসল কথাটা কেবল আমি জানতুম আর মা গঙ্গাই জানতেন।-- কী! এতবড়ো আস্পর্ধা-- তুই বিশ্বাস করিস নে! জানিস, তোকে বিয়ে করে তোর চোদ্দপুরুষকে উদ্ধার করেছি। বাপের বাড়ি যাবে? যাও-না! মরবার সময় আমার এই গঙ্গায় আসতে দেব না। সেটা মনে রেখো। ভাত আর আছে তো? নেই? আমি যে তোমাকে বেশি করে রাঁধতে বলে দিয়েছিলুম। আমার প্রসাদ নিয়ে যাবে বলে যে দেশ-বিদেশ থেকে লোক এসেছে। যা রেঁধেছ, এর একটা একটা ভাত খুঁটে দিলেও যে কুলোবে না। রান্নাঘরে যত ভাত আছে সব নিয়ে এসো-- তোমরা সব চিঁড়ে আনতে দাও, পুকুর থেকে গঙ্গাজল এনে ভিজিয়ে খেয়ো। কী করব বলো। দূর থেকে নাম শুনে প্রসাদ নিতে এসেছে, তাদের ফেরাতে পারব না। কী বললে? আমার হাতে পড়ে তোমার হাড় জ্বালাতন হয়ে গেল? কী বলব, তুমি মুর্খু মেয়েমানুষ, ঐ কথাটা একবার দেশের ভালো ভালো পণ্ডিতদের কাছে বলো দেখি। তারা তখনি মুখের উপর শুনিয়ে দেবে, ষাট হাজার সগরসন্তান জ্ব'লে ভস্ম হয়ে গিয়েছিল, সেই ভস্মে যিনি প্রাণ দিয়েছেন,তিনি যে তোমার হাড় জ্বালাবেন এ কথা কোনো শাস্ত্রের সঙ্গেই মিলছে না। তুমি গাল দাও, আমি আমার ভক্তদের কাছে চললুম।

(বাহিরে আসিয়া) দেরি হয়ে গেল। বাড়ির মধ্যে এঁয়ারা সব আবার কিছুতেই ছাড়েন না, পায়ের ধুলো নিয়ে পুজো করে বেলা করে দিলেন। আমি বলি, থাক্‌ থাক্‌, আর কাজ নেই-- তারা কি ছাড়ে! এসো, তোমরা একে একে এসো, যার যার ধুলো নেবার আছে নিয়ে বাড়ি যাও-- কী হে বিপিন? আজ মকদ্দমার দিন? তা তো যেতে পারছি নে। দর্শন করতে সব লোকজন আসছে। এক-তরফা ডিক্রি হবে? কী করব বলো। আমি উপস্থিত না থাকলে এখানেও যে এক-তরফা হয়। বিপ্‌নে, তুই যাবার সময় প্রণাম করে গেলি নে? এমনি করেই অধঃপাতে যাবে। আয়, এইখানে গড় কর্‌, এই নে, ধুলো নে। যা।
1 | 2 | 3