ছাদের এক কোণে শ্যামাসুন্দরী দাঁড়িয়ে দেখছিল
মধুসূদনের প্রবেশ
মধুসূদনের প্রবেশ
মধুসূদন।
তুমি কী করছ এত রাত্রে এখানে?
শ্যামাসুন্দরী।
শুয়ে ছিলুম। তোমার পায়ের শব্দ শুনে ভয় হল। ভাবলুম বুঝি--
মধুসূদন।
আস্পর্ধা বাড়ছে দেখছি। আমার সঙ্গে চালাকি করতে চেয়ো না। সাবধান করে দিচ্ছি!
শ্যামাসুন্দরী।
চালাকি করব না ঠাকুরপো। যা দেখতে পাচ্ছি তাতে চোখে ঘুম আসে না। আমরা তো আজ আসি নি, কতকালের সম্বন্ধ। আমরা সইব কী করে?
মধুসূদন।
আচ্ছা, থামো। বড়োবউকে পাঠিয়ে দাও আমার শোবার ঘরে।
[ শ্যামাসুন্দরীর প্রস্থান
[ শ্যামাসুন্দরীর প্রস্থান
কুমুদিনীর প্রবেশ
কুমুদিনীর প্রবেশ
মধুসূদন।
এসো, বোসো।
কুমুদিনী সোফায় বসল, মধুসূদন বসল মেঝের উপর পায়ের কাছে। কুমুদিনী উঠতে যাচ্ছিল।
মধুসূদন হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলে
কুমুদিনী সোফায় বসল, মধুসূদন বসল মেঝের উপর পায়ের কাছে। কুমুদিনী উঠতে যাচ্ছিল।
মধুসূদন হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলে
মধুসূদন।
উঠো না, শোনো আমার কথা। আমি এখনি আসছি। বলো তুমি চলে যাবে না।
কুমুদিনী।
না, যাব না।
মধুসূদনের প্রস্থান। কুমুদিনীর মৃদুস্বরে গান।
মধুসূদনের প্রস্থান। কুমুদিনীর মৃদুস্বরে গান।
নবীন ও মোতির মাকে নিয়ে মধুসূদনের প্রবেশ
নবীন ও মোতির মাকে নিয়ে মধুসূদনের প্রবেশ
মধুসূদন।
শোনো বলি, কাল তোমাদের রজবপুরে যেতে বলেছিলুম, কিন্তু তার দরকার নেই। কাল থেকে বিশেষ করে বড়োবউয়ের সেবায় তোমাকে নিযুক্ত করে দিলুম। এই বলে দিলুম, এখন যাও।
[ উভয়ের প্রস্থান
কাছে এসে
বড়োবউ-- তোমার দাদার টেলিগ্রাম এসেছে!
কুমুদিনী চমকে উঠল
আশীর্বাদ জানিয়েছেন, লিখেছেন উদ্বেগের কারণ নেই। বড়োবউ, তুমি কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছ?
কুমুদিনী।
না, আমার রাগ নেই, একটুও না।
মধুসূদন।
তোমার জন্যে কী এনেছি দেখো। তোমার দাদার দেওয়া সেই নীলার আংটি, আমাকে তুমি এই আংটি পরিয়ে দিতে দেবে? ভুল করেছিলুম তোমার হাতের আংটি খুলে নিয়ে। তোমার হাতে কোনো জহরতে দোষ নেই।
মুক্তোমালা বের করে
তোমার জন্যে মুক্তার মালা এনেছি। কেমন, পছন্দ হয়েছে? খুশি হয়েছ? আমি পরিয়ে দেব?
কুমুদিনী নিরুত্তর
বুঝেছি, দরখাস্ত নামঞ্জুর। বড়োবউ, তোমার বুকের কাছে আমার অন্তরের এই দরখাস্তটি লটকিয়ে দেব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু তার আগেই ডিস্মিস্। আচ্ছা, আর-একটি জিনিস যদি দিই তো কী দেবে বলো! যেমন জিনিসটি তার উপযুক্ত দাম নেব কিন্তু!
এস্রাজ এনে দিলে
এস্রাজ এনে দিলে
কুমুদিনী।
কোথায় পেলে?
মধুসূদন।
তোমার দাদা পার্সেল করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কেমন, এবার খুশি হয়েছ তো? তবে দাম দাও।
কুমুদিনী।
কী?
মধুসূদন।
বাজিয়ে শোনাও আমাকে। আমার সামনে লজ্জা কোরো না।
কুমুদিনী।
সুর বাঁধা নেই।
মধুসূদন।
তোমার নিজের মনেরই সুর বাঁধা নেই, তাই বলো-না কেন!
কুমুদিনী।
যন্ত্রটা ঠিক করে রাখি, তোমাকে আর-এক দিন শোনাব।
মধুসূদন।
কবে, ঠিক করে বলো, কাল?
কুমুদিনী।
বেশ, কাল।
মধুসূদন।
সন্ধেবেলায় আফিস থেকে ফিরে এলে?
কুমুদিনী।
তাই হবে।
মধুসূদন।
এস্রাজটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছ?
কুমুদিনী।
হয়েছি।--
মধুসূদন।
বড়োবউ, আজ তুমি আমার কাছে কিছু চাও। যা চাও তাই পাবে।
কুমুদিনী।
মুরলীকে একখানা শীতের কাপড় দিতে চাই।
মধুসূদন।
লক্ষ্ণীছাড়া মুরলী বুঝি তোমাকে বিরক্ত করেছে?
কুমুদিনী।
না, আমি নিজেই ওকে একটা আলোয়ান দিতে গেলুম, ও নিলে না। তুমি যদি হুকুম কর তবেই সাহস করে নেবে।
মধুসূদন।
ভিক্ষে দিতে চাও? আচ্ছা, কই দেখি তোমার আলোয়ান!
কুমুদিনীর আলোয়ান নিজের গায়ে জড়িয়ে নিলে
মুরলী!
মুরলীর প্রবেশ
মুরলীর প্রবেশ
মুরলী।
হুজুর!
একশো টাকার নোট দিয়া
একশো টাকার নোট দিয়া
মধুসূদন।
তোমার মা'জি তোমাকে বকশিশ দিয়েছেন।
মুরলী।
হুজুর--
মধুসূদন।
হুজুর কী রে ব্যাটা! বোকা, নে তোর মায়ের হাত থেকে। এই টাকা দিয়ে যত খুশি গরম কাপড় কিনে নিস। যা!--
মুরলীর প্রস্থান ও পুনঃপ্রবেশ
মুরলীর প্রস্থান ও পুনঃপ্রবেশ
মুরলী।
হুজুর, বড়োসাহেবের কাছ থেকে কানু দালাল এসেছে।
তাড়াতাড়ি উঠে
তাড়াতাড়ি উঠে
মধুসূদন।
আমি যত শীগগির পারি আসছি। ডেকে দিয়ে যাচ্ছি মেজোবউকে।
[প্রস্থান
[প্রস্থান
মোতির মায়ের প্রবেশ
মোতির মায়ের প্রবেশ
মোতির মা।
দিদি!
কুমুদিনী।
এসো ভাই, এসো। আমার দাদার টেলিগ্রাম পেয়েছি।
মোতির মা।
কেমন আছেন? বড়োঠাকুর এনে দিলেন বুঝি?
কুমুদিনী।
ভালোই আছেন।
মোতির মা।
আজ মনে হল বড়োঠাকুরের মনটা যেন প্রসন্ন।
কুমুদিনী।
এ প্রসন্নতা যে কেন ঠিক বুঝতে পারি নে। তাই ভয় হয়। কী করতে হবে কিছুই ভেবে পাই নে।
মোতির মা।
কিছুই ভাবতে হবে না। এটুকু বুঝতে পারছ না, এতদিন উনি কেবল কারবার করে এসেছেন, তোমার মতো মেয়েকে কেনোদিন দেখেন নি। এখন একটু একটু করে যতই তোমায় চিনছেন, ততই তোমার আদর বাড়ছে।
কুমুদিনী।
বেশি দেখলে বেশি চিনবেন, এমন কিছুই আমার মধ্যে নেই ভাই। আমি নিজেই যেন দেখতে পাচ্ছি আমার ভিতরটা একেবারে শূন্য! সেইজন্যে হঠাৎ যখন দেখি উনি খুশি হয়েছেন, আমার মনে হয় উনি বুঝি ঠকেছেন; যেই সেটা ফাঁস হবে অমনি আরো রেগে উঠবেন!
মোতির মা।
এ তোমার ভুল ধারণা। বড়োঠাকুর সত্যিই তোমাকে ভালোবাসেন, এ কথা মনে রেখো!
কুমুদিনী।
সেইটেই তো আমার আরো আশ্চর্য ঠেকে!
মোতির মা।
বলো কী দিদি! তোমাকে ভালোবাসা আশ্চর্য! কেন, উনি কি পাথরের?
কুমুদিনী।
আমি ওঁর যোগ্য নই।
মোতির মা।
তুমি যার যোগ্য নও সে পুরুষ পৃথিবীতে আছে?
কুমুদিনী।
ওঁর কত বড়ো শক্তি, কত সম্মান, কত মস্ত মানুষ উনি। আমার মধ্যে উনি কতটুকু পেতে পারেন?
মোতির মা।
দিদি, তুমি হাসালে! বড়োঠাকুরের মস্ত বড়ো কারবার, কারবারি বুদ্ধিতে ওঁর জুড়ি নেই-- সব মানি। কিন্তু তুমি কি ওঁর আপিসের ম্যানেজারি করতে এসেছ যে যোগ্য নই বলে ভয় পাবে? বড়োঠাকুর যদি মনের কথা খোলসা করে বলেন তো দেখবে, তিনিও স্বীকার করবেন যে তিনি তোমার যোগ্য নন। আর, তোমার নিজের দাম কী জানো দিদি? যেদিন এদের বাড়িতে এসেছ সেই দিনই তোমার পক্ষ থেকে যা দেওয়া হল, এরা সবাই মিলে তা শুধতে পারলে না। আমার কর্তাটি একেবারে মরিয়া। তোমার জন্য সাগর লঙ্ঘন করতে না পারলে স্থির থাকতে পারছেন না। আমি যদি তোমায় ভালো না বাসতুম তো এই নিয়ে তাঁর সঙ্গে ঝগড়া হয়ে যেত।
কুমুদিনী।
কত ভাগ্যে এমন দেওর পেয়েছি।
মোতির মা।
আর, তোমার এই জা'টি? বুঝি ভাগ্যস্থানে রাহু, না কেতু?
কুমুদিনী।
তোমাদের একজনের নাম করলে আর-একজনের নাম করবার দরকার হয় না।
মোতির মা।
ওই-যে আসছেন তোমার দেওর লক্ষ্ণণটি।
নবীনের প্রবেশ
নবীনের প্রবেশ
কুমুদিনী।
এসো এসো ঠাকুরপো। কী খুঁজছ?
নবীন।
ঘরের আলোটিকে ঘরে দেখতে না পেয়ে খুঁজতে বেরিয়েছি।
মোতির মা।
হায় হায়, মণিহারা ফণী যাকে বলে!
নবীন।
কে মণি আর কে ফণী তা চক্র নাড়া দেখলেই বোঝা যায়, কী বলো বউরানী?
কুমুদিনী।
আমাকে সাক্ষী মেনো না ঠাকুরপো।
নবীন।
ও-সব কথা এখন থাক্। তোমার দাদার চিঠি এনেছি।
কুমুদিনী।
দেখি দেখি। দাদা আজ বিকেলে তিনটের সময় কলকাতায় এসেছেন।
নবীন।
আজই এসেছেন! তাঁর তো--
কুমুদিনী।
লিখেছেন, বিশেষ কারণে আজই আসতে হল।
নবীন।
বউরানী, তাঁর কাছে তো কালই যাওয়া চাই।
কুমুদিনী।
না, আমি যাব না।
মুখে আঁচল চেপে কান্না
মুখে আঁচল চেপে কান্না
মোতির মা।
কেন, কী হল দিদি?
কুমুদিনী।
দাদা আমাকে যেতে বারণ করেছেন।
নবীন।
বউরানী, তুমি নিশ্চয় ভুল করেছ।
কুমুদিনী।
না, এই তো লিখেছেন।
নবীন।
কোথায় ভুল করেছ বলব? তোমার দাদা নিশ্চিত ঠিক করেছেন যে, আমার দাদা তোমাকে তাঁদের ওখানে যেতে দেবেন না। সেই অপমান থেকে বাঁচাবার জন্যে তিনি তোমার রাস্তা সোজা করে দিয়েছেন। বুঝতে পেরেছ?
কুমুদিনী।
পেরেছি।
কুমুদিনীর চিবুক ধরে
কুমুদিনীর চিবুক ধরে
মোতির মা।
বাস্ রে! দাদার কথার একটু আড় হাওয়াতেই অভিমানের সমুদ্র উথলে ওঠে।
নবীন।
বউরানী, কাল তা হলে তোমার যাবার আয়োজন করি।
কুমুদিনী।
না, তার দরকার নেই।
নবীন।
দরকার আমাদের পক্ষেই যে আছে। তোমার দাদাকে দেখতে যাবার বাধা ঘটলে সে নিন্দে আমাদের সইবে কেন? চুপ করে রইলে কেন বউরানী? তোমার যাওয়া ঘটবেই, আর কালই ঘটবে এ আমি বলে দিচ্ছি।
মোতির মা।
কী উপায়টা ভেবেছ একটু খোলসা করে বলো দেখি বুদ্ধিমান।
নবীন।
দাদাকে গিয়ে বলব, বউরানীকে ওদের ওখানে যেতে দেওয়া চলবেই না। তুমি হয়তো রাজি হতে পার, কিন্তু এ অপমান আমরা সইব না। শুনলেই দাদা আমার উপরে আগুন হয়ে উঠবে। তখনি পালকির হুকুম হবে। ওই-যে আসছেন দাদা।
[ উভয়ের প্রস্থান
[ উভয়ের প্রস্থান
মধুসূদনের প্রবেশ
মধুসূদনের প্রবেশ
মধুসূদন।
শুতে আসবে না বড়োবউ? এখানে তোমার ঠাণ্ডা লাগবে যে। চলো, তোমার আপন ঘরে। যেতে ইচ্ছে করছে না? বড়োবউ, দোষ করে থাকি তো মাপ করো! আমি তোমার অযোগ্য-- আমাকে দয়া করবে না?
কুমুদিনী।
ছি ছি, অমন করে বোলো না। আমাকে অপরাধী কোরো না। আমি তোমার দাসী। আমাকে আদেশ করো।
মধুসূদন।
না, আর তোমাকে আদেশ করব না। তুমি আপন ইচ্ছাতে আমার কাছে এসো। নিজে থেকে কি তুমি আমার কাছে আসবে না, বড়োবউ?
কুমুদিনী।
তুমি আদেশ করলে আমার কর্তব্য সহজ হয়। আমি নিজে ভেবে কিছু করতে পারি নে।
মধুসূদন।
বেশ! তবে তুমি তোমার গায়ের ওই চাদরখানা খুলে ফেলো।
কুমুদিনী গায়ের চাদর নামিয়ে রাখল
আশ্চর্য সুন্দর তুমি!
কুমুদিনী।
আমাকে তুমি মাপ করো, দয়া করো।
মধুসূদন।
কী দোষ করেছ যে তোমায় মাপ করতে হবে?
কুমুদিনী।
এখনো আমার মন তৈরি হয় নি। আমায় একটুখানি সময় দাও।
মধুসূদন।
কিসের জন্য সময় দিতে হবে বুঝিয়ে বলো!
কুমুদিনী।
ঠিক বলতে পাচ্ছি না। কাউকে বুঝিয়ে বলা শক্ত!
মধুসূদন।
কিছুই শক্ত না! তুমি বলতে চাও, আমাকে তোমার ভালো লাগছে না।
কুমুদিনী।
তোমাকে ফাঁকি দিতে চাই না বলেই বলছি-- আমাকে একটু সময় দাও।
মধুসূদন।
সময় দিলে কী সুবিধে হবে শুনি? তোমার দাদার সঙ্গে পরামর্শ করে স্বামীর ঘর করতে চাও? তোমার দাদা তোমার গুরু? সে যেমন চালাবে তুমি তেমনি চলবে?
কুমুদিনী।
হাঁ! আমার দাদা আমার গুরু!
মধুসূদন।
তাঁর হুকুম না হলে বিছানায় শুতে আসবে না, কেমন? তা হলে টেলিগ্রাম করে হুকুম আনাই, রাত অনেক হল!
কুমু যেতে উদ্যত
যেয়ো না বলছি!
কুমুদিনী।
কী চাও বলো।
মধুসূদন।
এখনি কাপড় ছেড়ে এসো, পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি।
কুমুদিনী।
দরকার নেই, এই আমার আটপৌরে কাপড়। এখন কী করতে চাও আমাকে বলো।
মধুসূদন।
বড়োবউ, তোমার মন কি পাথরে গড়া?
হাত ধরে সবলে নাড়া দিয়ে
তুমি কি কিছুতে আমাকে সইতে পাচ্ছ না? কিছুতে আমার কাছে ধরা দেবে না? আমাকে কোনোমতেই সইতে পারছ [ না ]? আচ্ছা, যাও, যাও, তোমার দাদার কাছে যাও! কালই যেয়ো। কী, চুপ করে রইলে যে! যেতে চাও না?
কুমুদিনী।
না, আমি চাই নে।
মধুসূদন।
কেন?
কুমুদিনী।
তা আমি বলতে পারি নে।
মধুসূদন।
বলতে পার না? আবার তোমার সেই নুরনগরী চাল!
কুমুদিনী।
আমি নুরনগরেরই মেয়ে।
মধুসূদন।
যাও, তাদেরই কাছে যাও। যোগ্য নও তুমি এখানকার। অনুগ্রহ করেছিলেম, মর্যাদা বুঝলে না। এখন অনুতাপ করতে হবে। কাঠ হয়ে বসে রইলে যে!
ঝাঁকানি দিয়ে
মাপ চাইতেও জান না?
কুমুদিনী।
কিসের জন্যে?
মধুসূদন।
তুমি যে আমার এই বিছানা[য় ] শুতে পেরেছ সেই অযোগ্যতার জন্যে? রোসো, একটু দাঁড়াও। আমি বলে দিচ্ছি, কালই তোমাকে যেতেই হবে তোমার দাদার ওখানে, কিংবা যেখানে খুশি। ভেবে রেখেছ তোমাকে নইলে আমার চলবে না। এতদিন চলেছিল, আজও চলবে, ভালোই চলবে। যাও তবে, তোমার ওই ফরাসখানার ঘর পড়ে আছে, যাও ওখানে শুতে।
[ কুমুদিনীর প্রস্থান
যাক গে।
শ্যামাসুন্দরীর আবির্ভাব
কে, শ্যামা? কী করছ শ্যামা? কী চাই তোমার? আমায় কিছু বলবে? চলো, যাচ্ছি।
শ্যামাসুন্দরী।
ঠাকুরপো, আমায় মেরে ফেলো তুমি। আর সইছে না-
মধুসূদন।
ঈস্! তোমার গা যে একেবারে ঠাণ্ডা হিম। চলো, চলো, হিমে নয়। চলো আমার ঘরে।
নিজের শালের এক অংশে শ্যামাকে আবৃত করে চলে গেল।
সেই মুহূর্তে মোতির মা এবং নবীনের প্রবেশ
নিজের শালের এক অংশে শ্যামাকে আবৃত করে চলে গেল।
সেই মুহূর্তে মোতির মা এবং নবীনের প্রবেশ
মোতির মা।
না, এ আমি কিছুতেই সইব না। আমি বাধা দেব।
নবীন।
তাতে আরো অনর্থ বাড়বে মেজোবউ। বাধা দিতে পারবে না।
মোতির মা।
ভগবান কি তবে এও চোখ মেলে দেখবেন? এমন নীচের হাতে অপমান দিদির কপালে ছিল?
নবীন।
আশ্চর্য হবার তো কিছু নেই। যে ঘুমন্ত ক্ষুধাকে বউরানী জাগিয়েছেন তার অন্ন জোগাতে পারেন নি। তাই সে অনর্থপাত করতে বসেছে।
মোতির মা।
তবে কি এটা এমনি ভাবেই চলবে?
নবীন।
যে আগুন নেভাবার কোনো উপায় নেই সেটাকে আপনি জ্বলে ছাই হওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে দেখতে হবে।
কুমুদিনীর প্রবেশ
কুমুদিনীর প্রবেশ
কুমুদিনী।
আজ তোমার ঘরে আমাকে জায়গা দিতে হবে বোন।
মোতির মা।
সে কী কথা!
কুমুদিনী।
আজ রাত্তির থেকেই আমার শুভ নির্বাসন মঞ্জুর হয়েছে। কাল যাব দাদার ওখানে। ঠাকুরপো, রাগ কোরো না।
নবীন।
বউরানী, ফিরে আসতে দেরি কোরো না এই কথাটা সব মন দিয়ে বলতে পারলে বেঁচে যেতুম--কিন্তু মুখ দিয়ে বেরোল না। যাদের কাছে তোমার যথার্থ সম্মান সেইখানেই থাকো গিয়ে। অভাগা নবীনকে যদি কোনো কারণে কোনো কালে দরকার হয় স্মরণ কোরো।
কুমুদিনী।
আপাতত দরকার তোমার ঘরে আশ্রয় নেওয়া। রাগ করবে না তো?
নবীন।
রাগ করব আমি! দ্বারের বাইরে দরোয়ানি করবার এমন সুযোগ আর আমি পাব না।
কুমুদিনী।
আনন্দে ঘুম তো হবে না সারা রাত-- তোমাকেও যদি জাগিয়ে রাখি ঠাকুরপো!
নবীন।
তা হলে তো আমার ঘরে কোজাগরী লক্ষ্ণীপূর্ণিমা হবে।
কুমুদিনী।
তোমাদের ভাগ্নী ওই ফুট্কিকে ডেকে আনো তো ভাই।
নবীন।
কেন, তাকে কিসের দরকার?
কুমুদিনী।
সীতার অগ্নিপ্রবেশে সেই তো সীতা সেজেছিল। আবার শুনব তার মুখে তার পালার শেষ কথা ক'টি।
[ নবীনের প্রস্থান
[ নবীনের প্রস্থান
মোতির মা।
ইতিহাসটা খুলে বলো দিদি।
কুমুদিনী।
সেই একই কথা। হরিণী পিছু হটছিল, ব্যাধ তার গলায় ফাঁসটা ধরে জোরে দিয়েছিল টান। ফাঁস গেল ছিঁড়ে। ব্যাধ অহংকার করে বললে, ভালোই হল; হরিণ নম্র হয়ে বললে, ভালোই হয়েছে।
মোতির মা।
এইখানেই কি শেষ হবে বোন? অদৃষ্টের মৃগয়া যে এখনো চলবে।
কুমুদিনী।
তা জানি, ওই ব্যাধের হাতে ধনুক আছে, বল্লম আছে, খাঁড়া আছে, আর হরিণীর আছে কেবল তার শেষ পরিত্রাণ মরণ।
ফুট্কিকে লইয়া নবীনের প্রবেশ
ফুট্কিকে লইয়া নবীনের প্রবেশ
কুমুদিনী।
ফুট্কি!
ফুট্কি।
কী রানীমা!
কুমুদিনী।
আগুন থেকে বেরিয়ে এসে সীতা কী বললেন গান গেয়ে বল্।
ফুট্কির গান
ফুট্কির গান
ফুরালো পরীক্ষার এই পালা,
পার হয়েছি আমি অগ্নিদহনজ্বালা॥
মা গো মা, মা গো মা,
এবার তুমিই জাগো মা,
তোমার কোলে উজাড় করে দেব অপমানের ডালা॥
তোমার শ্যামল আঁচলখানি
আমার অঙ্গে দাও মা, টানি,
আমার বুকের থেকে লও খসিয়ে নিঠুর কাঁটার মালা।
মা গো মা॥
কুমুদিনী।
তার পরে যখন রাম বললেন, এসো আমার সিংহাসনে এসো, বোসো আমার বামে--
ফুট্কির গান
ফুট্কির গান
ফিরে আমায় মিছে ডাক', স্বামী।
সময় হল, বিদায় লব আমি॥
অপমানে যার সাজায় চিতা
সে যে বাহির হয়ে এল অগ্নিজিতা,
রাজাসনের কঠিন অসম্মানে
ধরা দিবে না সে যে মুক্তিকামী॥
আমায় মাটি নেবে আঁচল পেতে
বিশ্বজনের চোখের আড়ালেতে,
তুমি থাকো সোনার সীতার অনুগামী।
ফিরে ফিরে আমায় মিছে ডাক' স্বামী॥