প্রত্যেক ভাষার একটি স্বকীয় ধ্বনি-উদ্ভাবনা আছে। তার থেকে তার স্বরূপ চেনা যায়। ইংরেজিতে বেশির ভাগ শব্দে স্বরবর্ণের মধ্যস্থতা নেই বলে সে যেন হয়েছে সরোদ যন্ত্রের মতো, আঙুলের আঘাতে তার ঐক্যমাত্রিক ধ্বনিগুলি উচ্চকিত, ইটালিয়নে ছড়ির লম্বা টানে বেহালার টানা সুর।

বাংলাভাষারও নিজের একটা বিশেষ ধ্বনিস্বরূপ আছে। তার ধ্বনির এই চেহারা হসন্তবর্ণের যোগে। যে-বাংলা আমাদের মায়ের কণ্ঠগত, জ্যেষ্ঠতাতের লেখনীগত নয়, ইংরেজির মতো তারও সুর ব্যঞ্জনবর্ণের সংঘাতে। আজ সাধুভাষার ছন্দে জোর দেবার অভিপ্রায়ে অভিধান ঘেঁটে যুক্তবর্ণের আয়োজনে লেগেছি, অথচ প্রাকৃত-বাংলায় হসন্তের প্রাধান্য আছে বলেই যুক্তবর্ণের জোর তার মধ্যে আপনি এসে পড়ে। এই ভাষায় একটি শ্লোক রচনা করা যাক একটিও যুক্তবর্ণ না দিয়ে।

দূর সাগরের পারের পবন

আসবে যখন কাছের কূলে

রঙিন আগুন জ্বালবে ফাগুন,

মাতবে অশোক সোনার ফুলে।

হসন্তের ধাক্কায় যুক্তবর্ণের ঢেউ আপনি উঠেছে।

চীনদেশের সাংঘাই নগরে একটি আরামবাগ আছে। অনেককাল সেখানে চীনের লোকেরই প্রবেশ-নিষেধ ছিল। তেমনি বাংলাদেশের সাহিত্য-আরামবাগ থেকে বাংলাভাষার স্বকীয় ধ্বনিরূপটি পণ্ডিত-পাহারাওয়ালার ধাক্কা খেয়ে অনেক কাল বাইরে বাইরে ফিরেছিল।

ভাষার শব্দে অর্থ আছে, স্বর আছে। অর্থ জিনিসটা সকল ভাষাতেই এক, স্বরটা প্রত্যেক ভাষাতেই স্বতন্ত্র। "জল' শব্দে যা বোঝায় "water' শব্দেও তাই বুঝি, কিন্তু ওদের সুর আলাদা। ভাষা এই সুর নিয়ে শিল্প রচনা করে, ধ্বনির শিল্প। সেই রূপসৃষ্টির যে ধ্বনিতত্ত্ব বাংলাভাষার আপন সম্বল পণ্ডিতরা তাকে অবজ্ঞা করতে পারেন, কেননা, তাঁরা অর্থের মহাজন; কিন্তু, যাঁরা রূপরসিক তাঁদের মূলধন ধ্বনি। প্রাকৃত-বাংলার দুয়োরানীকে যারা সুয়োরানীর অপ্রতিহতপ্রভাবে সাহিত্যের গোয়ালঘরে বাসা না দিয়ে হৃদয়ে স্থান দিয়েছে, সেই "অশিক্ষিত'-লাঞ্ছনাধারীর দল যথার্থ বাংলাভাষার সম্পদ নিয়ে আনন্দ করতে বাধা পায় না। তাদের প্রাণের গভীর কথা তাদের প্রাণের সহজ ভাষায় উদ্‌ধৃত করে দিই।

আছে যার মনের মানুষ আপন মনে

সে কি আর জপে মালা।

নির্জনে সে বসে বসে দেখছে খেলা।

কাছে রয়, ডাকে তারে

উচ্চস্বরে

কোন্‌ পাগোলা,

ওরে যে যা বোঝ তাই সে বুঝে

থাকে ভোলা।

যেথা যার ব্যথা নেহাত

সেইখানে হাত

ডলামলা,

তেমনি জেনো মনের মানুষ মনে তোলো।

যে জনা দেখে সে রূপ

করিয়া চুপ,

রয় নিরালা।

ওরে লালন-ভেড়ের লোক-দেখানো

মুখে "হরি হরি' বোলা।

আর-একটি--

এমন মানব-জনম আর কি হবে।

যা কর মন ত্বরায় করো

এই ভবে।

অনন্তরূপ ছিষ্টি করেন সাঁই,

শুনি মানবের তুলনা কিছুই নাই।

দেব-দেবতাগণ

করে আরাধন

জন্ম নিতে মানবে। ...

এই মানুষে হবে মাধুর্যভজন

তাইতে মানুষ-রূপ গঠিল নিরঞ্জন।

এবার ঠকলে আর

না দেখি কিনার,

লালন কয় কাতরভাবে।

এই ছন্দের ভঙ্গি একঘেয়ে নয়। ছোটো বড়ো নানা ভাগে বাঁকে বাঁকে চলেছে। সাধুপ্রসাধনে মেজে-ঘষে এর শোভা বাড়ানো চলে, আশা করি এমন কথা বলবার সাহস হবে না কারো।

এই খাঁটি বাংলায় সকল রকম ছন্দেই সকল কাব্যই লেখা সম্ভব, এই আমার বিশ্বাস। ব্যঙ্গকবিতায় এ ভাষার জোর কত ঈশ্বরগুপ্তের কবিতা থেকে তার নমুনা দিই। কুইন ভিক্টোরিয়াকে সম্বোধন করে কবি বলছেন--

তুমি মা কল্পতরু,

আমরা সব পোষা গোরু

শিখি নি শিঙ-বাঁকানো,

কেবল খাব খোল বিচিলি ঘাস।

যেন রাঙা আমলা তুলে মামলা

গামলা ভাঙে না,

আমরা ভুষি পেলেই খুশি হব

ঘুষি খেলে বাঁচব না।

কেবল এর হাসিটি নয়, এর ছন্দের বিচিত্র ভঙ্গিটা লক্ষ্য করে দেখবার বিষয়।

অথচ, এই প্রাকৃত-বাংলাতেই "মেঘনাদবধ' কাব্য লিখলে যে বাঙালিকে লজ্জা দেওয়া হত সে কথা স্বীকার করব না। কাব্যটা এমন ভাবে আরম্ভ করা যেত--

যুদ্ধ যখন সাঙ্গ হল বীরবাহু বীর যবে

বিপুল বীর্য দেখিয়ে হঠাৎ গেলেন মৃত্যুপুরে

যৌবনকাল পার না হতেই, কও মা সরস্বতী,

অমৃতময় বাক্য তোমার, সেনাধ্যক্ষপদে

কোন্‌ বীরকে বরণ করে পাঠিয়ে দিলেন রণে

রঘুকুলের পরম শত্রু, রক্ষকুলের নিধি।

এতে গাম্ভীর্যের ত্রুটি ঘটেছে এ কথা মানব না। এই যে-বাংলা বাঙালির দিনরাত্রির ভাষা এর একটি মস্ত গুণ, এ ভাষা প্রাণবান্‌। এইজন্যে সংস্কৃত বল, পারসি বল, ইংরেজি বল, সব শব্দকেই প্রাণের প্রয়োজনে আত্মসাৎ করতে পারে। খাঁটি হিন্দি ভাষারও সেই গুণ। যারা হেড্‌পণ্ডিত মশায়ের কাছে পড়ে নি তাদের একটা লেখা তুলে দিই--

চক্ষু আঁধার দিলের ধোঁকায়

কেশের আড়ে পাহাড় লুকায়,

কী রঙ্গ সাঁই দেখছে সদাই

বসে নিগম ঠাঁই।

এখানে না দেখলেম তারে

চিনব তবে কেমন ক'রে,

ভাগ্যেতে আখেরে তারে

চিনতে যদি পাই।

প্রাকৃত-বাংলাকে গুরুচণ্ডালি দোষ স্পর্শই করে না। সাধু ছাঁদের ভাষাতেই শব্দের মিশোল সয় না।

চলতি বাংলাভাষার প্রসঙ্গটা দীর্ঘ হয়ে পড়ল। তার কারণ, এ ভাষাকে যাঁরা প্রতিদিন ঘরে দেন স্থান, তাঁদের অনেকে সাহিত্যে একে অবজ্ঞা করেন। সেটাতে সাহিত্যকে তার প্রাণরসের মূল আধার থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে জেনে আমার আপত্তিকে বড়ো করেই জানালুম। ছন্দের তত্ত্ববিচারে ভাষার অন্তর্নিহিত ধ্বনিপ্রকৃতির বিচার অত্যাবশক, সেই কথাটা এই উপলক্ষ্যে বোঝাবার চেষ্টা করেছি।

বাংলা ছন্দের তিনটি শাখা। একটি আছে পুঁথিগত কৃত্রিম ভাষাকে অবলম্বন করে, সেই ভাষায় বাংলার স্বাভাবিক ধ্বনিরূপকে স্বীকার করে নি। আর-একটি সচল বাংলার ভাষাকে নিয়ে, এই ভাষা বাংলার হসন্ত-শব্দের ধ্বনিকে আপন বলে গ্রহণ করেছে। আর-একটি শাখার উদগম হয়েছে সংস্কৃত ছন্দকে বাংলায় ভেঙে নিয়ে।

শিখরিণী মালিনী মন্দাক্রান্তা শার্দূলবিক্রীড়িত প্রভৃতি বড়ো বড়ো গম্ভীরচালের ছন্দ গুরুলঘুস্বরের যথানির্দিষ্ট বিন্যাসে অসমান মাত্রাভাগের ছন্দ। বাংলায় আমরা বিষমমাত্রামূলক ছন্দ কিছু কিছু চালিয়েছি, কিন্তু বিষমমাত্রার ঘনঘন পুনরাবৃত্তির দ্বারা তারও একটা সম্মিতি রক্ষা হয়।

শিমূল রাঙা রঙে

চোখেরে দিল ভরে।

নাকটা হেসে বলে,

হায় রে যাই মরে

নাকের মতে, গুণ

কেবলি আছে ঘ্রাণে,

রূপ যে রঙ খোঁজে

নাকটা তা কি জানে।

এখানে বিষমমাত্রার পদগুলি জোড়ে-জোড়ে এসে চলনের অসমানতা ঘুচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু, সংস্কৃত ভাষায় বিষমমাত্রার বিস্তার আরো অনেক বড়ো। এই সংস্কৃত ছন্দের দীর্ঘহ্রস্ব স্বরকে সমান করে নিয়ে কেবলমাত্র মাত্রা মিলিয়ে ছন্দ রচনা বাংলায় দেখেছি, সে বহুকাল পূর্বে "স্বপ্নপ্রয়াণ'এ।

লজ্জা বলিল, "হবে

কি লো তবে,

কতদিন পরান রবে

অমন করি।

হইয়ে জলহীন

যথা মীন

রহিবি ওলো কতদিন

মরমে মরি।"

এর প্রত্যেক ভাগে মাত্রাসংখ্যা স্বতন্ত্র।

সংস্কৃত ছন্দে বিবিধ মাত্রার এই গতিবৈচিত্র্য যা সম্মিতি উপেক্ষা করেও ভঙ্গিলীলা বাঁচিয়ে চলে, বাংলায় তার অনুকৃতি এখনো যথেষ্ট প্রচলিত হয় নি। নূতন ছন্দ বাংলায় সৃষ্টি করবার শখ যাঁদের প্রবল, এই পথে তাঁরা অনেক নূতনত্বের সন্ধান পাবেন। তবু বলে রাখি, তাতে তাঁরা সংস্কৃত ছন্দের মোট আয়তনটা পাবেন, তার ধ্বনিতরঙ্গ পাবেন না। মন্দাক্রান্তার মাত্রা-গোনা একটা বাংলা ছন্দের নমুনা দেওয়া যাক।

সারা প্রভাতের বাণী

বিকালে গেঁথে আনি

ভাবিনু হারখানি

দিব গলে।

ভয়ে ভয়ে অবশেষে

তোমার কাছে এসে

কথা যে যায় ভেসে

আঁখিজলে।

দিন যবে হয় গত

না-বলা কথা যত

খেলার ভেলা-মতো

হেলাভরে

লীলা তার করে সারা

যে-পথে ঠাঁইহারা

রাতের যত তারা

যায় সরে।

শিখরিণীকেও এই ভাবে বাংলায় রূপান্তরিত করা যেতে পারে।

কেবলি অহরহ মনে-মনে

নীরবে তোমা-সনে

যা-খুশি কহি কত;

বিরহব্যথা মম নিজে নিজে

তোমারি মুরতি যে

গড়িছে অবিরত।

এ পূজা ধায় যবে তোমা-পানে

বাজে কি কোনোখানে,

কাঁপে কি মন তব।

জান কি দিবানিশি বহুদূরে

গোপনে বাজে সুরে

বেদনা অভিনব।

ছন্দ সম্বন্ধে আরো কিছু বলা বাকি রইল, আর কোনো সময়ে পরে বলবার ইচ্ছা আছে। উপসংহারে আজ কেবল এই কথাটি বলতে চাই যে, ছন্দের একটা দিক আছে যেটাকে বলা যেতে পারে কৌশল। কিন্তু, তার চেয়ে আছে বড়ো জিনিস যেটাকে বলি সৌষ্ঠব। বাহাদুরি তার মধ্যে নেই, সমগ্র কাব্যসৃষ্টির কাছে ছন্দের আত্মবিস্মৃত আত্মনিবেদনে তার উদ্ভব। কাব্য পড়তে গিয়ে যদি অনুভব করি যে, ছন্দ পড়ছি, তাহলে সেই প্রগল্‌ভ ছন্দকে ধিক্‌কার দেব। মস্তিষ্ক হৃৎপিণ্ড পাকস্থলী অতি আশ্চর্য যন্ত্র, সৃষ্টিকর্তা তাদের স্বাতন্ত্র্য ঢাকা দিয়েছেন। দেহ তাদেরকে ব্যবহার করে, প্রকাশ করে না। করে প্রকাশ যখন রোগে ধরে; তখন যকৃৎটা হয় প্রবল, তার কাছে মাথা হেঁট করে লাবণ্য। শরীরে স্বাস্থ্যের মতোই কবি ছন্দকে ভুলে থাকে, ছন্দ যখন তার যথার্থ আপন হয়।

বৈশাখ, ১৩৪১
1 | 2