বিজয়বাবু বলেন, "কর্তৃকারকের' "এ' কর্তা ও করণের খিচুড়ি হইতে উৎপন্ন বলিয়া মনে হয় না। এক সময়ে প্রাকৃত ভাষার গ্রন্থে সকল কর্তৃকারকের পদ-ই "এ' দিয়া চিহ্নিত পাই; "মহাবীর বলিলেন' এইরূপ কথাতে "মহাবীরে' পাই। এই প্রাকৃতের পূর্ববর্তী প্রাকৃতে দেখিতে পাই যে, একবচনে বেশির ভাগ ওকার চলিয়াছে; ও অল্প পরেই আবার ওকার ও আকার এই উভয় স্থলেই এক একার পাই, ও এই একারটি শেষে কেবল একবচনেই ব্যবহৃত হইয়াছে। উন্নতিশীল বা পরিবর্তনশীল মধ্যবাংলায় ভাষার যত পরিবর্তন ঘটিয়াছে, দূরপ্রদেশে ততটা ঘটে নাই; এখনো রংপুরের প্রাদেশিক ভাষায় কর্তৃকারকে সর্বত্রই একার ব্যবহৃত হয়, আসামের ভাষাতেও উহা রহিয়াছে। একটা প্রাচীন প্রাকৃত হইতেই বাংলা ও ওড়িষ্যার জন্ম; ওড়িয়া ভাষায় এখনো সুনির্দিষ্ট একজন লোকের নাম কর্তৃকারকে একার আছে; একজন নির্দিষ্ট পণ্ডিত বলিলেন যে তিনি আসিতে পারিবেন না, এ কথায় ওড়িয়াতে "পণ্ডিতে কহিলে' ইত্যাদি চলিয়া থাকে। একজন নির্দিষ্ট গোয়ালাকে লক্ষ্ণণ আংটির বিনিময়ে দুধ চাহিয়াছিলেন, সেই গোয়ালা যেভাবে তাহার অসম্মতি জানাইয়াছিল, তাহা পুঁথিতে এইরূপে লিখিত আছে-- "গউড়ে বইলে গছে মুদি ফলি থাএ।"
বিজয়বাবু কর্তৃকারকের এ চিহ্ন সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন তাহা আমি স্বীকার করিয়া লইলাম। আমার পূর্ব মন্তব্যের বিরুদ্ধ কয়েকটা দৃষ্টান্ত আমার মনে পড়িতেছে। যথা "তার অদ্ভুত ব্যবহারে লোকে হাসে" এখানে হাসে ক্রিয়া অকর্মক। "সবায় (সবাই) কোমর বেঁধে দাঁড়াল" ইহাও অকর্মক। এই সবায় বা সবাই শব্দ প্রাচীন পুঁথিতে "সভাএ' লিখিত হয়, বস্তুত ইহা এ-যুক্ত কর্তৃকারকেরই দৃষ্টান্ত।
হর্নলি প্রভৃতি ভাষাতত্ত্ববিৎ কর্তৃকারকের একার-যুক্ত রূপকে তির্যক্রূপ (oblique form) বলেন। অর্থাৎ ইহাতে শব্দটিকে কেমন যেন আড় করিয়া ধরা হয়। বাংলায় সম্বন্ধ কারকের "র' চিহ্ন অনেক স্থলেই বিশেষ্য পদের এই তির্যক্রূপের সহিত যুক্ত হয়, যথা, রামের, কানাই-এর; বহুবচনের "রা' চিহ্ন সম্বন্ধেও সেই নিয়ম, যথা, রামেরা, ভাইএরা ইত্যাদি।
আমি লিখিয়াছিলাম, কর্মকারকে অপ্রাণীবাচক শব্দের উত্তর টা টি যোগ না করিলে তাহার সঙ্গে "কে'-চিহ্ন বসে না। বিজয়বাবু তাহার ব্যতিক্রমের দৃষ্টান্ত দিয়াছেন-- "গাছকে ওড়িশায় গছ বলে", "অনেক লোকে আকাশকে চাঁদোয়ার মত পদার্থ মনে করে।"
প্রবাসীর একজন কবিরাজ পাঠক "বাংলা কথ্যভাষা প্রবন্ধে আমার একটি বাক্য-ত্রুটি নির্দেশ করিয়াছেন। আমি লিখিয়াছিলাম "বাংলায় যে অসংযুক্ত শব্দের পূর্বে স্বরবর্ণ ও পরে ব্যঞ্জনবর্ণ আছে সে শব্দ নিজের অকার বর্জন করে।" এই বাক্যে অনেকগুলি অদ্ভুত ভুল রহিয়া গিয়াছে। কবিরাজ মহাশয়ের নির্দেশমত আমি তাহা সংশোধন করিলাম-- "বাংলায় তিন অক্ষরের শব্দের অন্ত অক্ষরের সহিত যদি স্বর থাকে তবে মধ্যবর্তী বর্ণের অকার বর্জিত হয়, যেমন, পাগ্লা গর্মি ইত্যাদি। কবিরাজ মহাশয় "বচসা, জটলা, দরজা, খামকা, ঝরকা" ইত্যাদি কয়েকটি ব্যাভিচারের দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছেন। অগ্রহায়ণের শান্তিনিকেতন পত্রে আমরাও এরূপ দৃষ্টান্ত কয়েকটি দিয়াছি।
কবিরাজ মহাশয় বলেন যে, যদিচ আমরা বলি না, "লোকগুলাতে নিন্দা করে" কিন্তু "সব লোকে নিন্দা করে" বলা চলে। অতএব কর্তৃকারকে একার প্রয়োগ কেবল এক-বচনেই চলে এমন কথা জোর দিয়া বলা ঠিক নয়।
কর্মকারকে অপ্রাণীবাচক শব্দের উত্তর সাধারণত "কে" চিহ্ন বসে না, কিন্তু পরে "টা' বা "টি' থাকিলে বসে, আমি এই নিয়মের উল্লেখ করিয়াছিলাম। কিন্তু আমার ভাষা-প্রয়োগের দোষে কবিরাজ মহাশয় মনে করিয়াছেন যে আমার মতে "টা' "টি' বিশিষ্ট শব্দ কর্মকারকে নির্বিশেষে "কে' চিহ্ন গ্রহণ করে। এইজন্য তিনি কয়েকটি বিরুদ্ধ দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছেন যথা, "আগুনের তেজটা দেখ" "তরকারিটা খাওয়া গেল না।" ইত্যাদি।
কবিরাজ মহাশয় আমার বাক্যরচনায় যে শৈথিল্য নির্দেশ করিয়াছেন আমি কৃতজ্ঞতার সহিত সেই ত্রুটি স্বীকার করিতেছি।
কয়েকটি প্রতিশব্দ সম্বন্ধে তিনি যাহা বলেন তাহা চিন্তার যোগ্য। "যে রোগ পিতামাতা হইতে পুত্রপৌত্রে যায়" তাহাকে আয়ুর্বেদে "সঞ্চারিরোগ' বলে। Heredity কুলসঞ্চারিতা, inherited কুলসঞ্চারী বলিলে হয় না? আয়ুর্বেদে নাছোড়বান্দার একটি ঠিক সংস্কৃত প্রতিশব্দ আছে-- "অনুষঙ্গী'।
অগ্রহায়ণ, ১৩২৬