আমার প্রুফ-সংশোধনপ্রণালী দেখলেই বুঝতে পারবে আমি নিরঞ্জনের উপাসক-- চিহ্নের অকারণ উৎপাত সইতে পারি নে। কেউ কেউ যাকে ইলেক বলে (কোন্‌ ভাষা থেকে পেলে জানি নে) তার ঔদ্ধত্য হাস্যকর অথচ দুঃসহ। অসমাপিকা ক'রে ব'লে প্রভৃতিতে দরকার হ'তে পারে কিন্তু "হেসে' "কেঁদে'-তে একেবারেই দরকার নেই। "করেছে বলেছে'-তে ইলেক চড়িয়ে পাঠকের চোখে খোঁচা দিয়ে কী পুণ্য অর্জন করবে জানি নে। করবে চলবে প্রভৃতি স্বতঃসম্পূর্ণ শব্দগুলো কী অপরাধ করেছে যে, ইলেককে শিরোধার্য করতে তারা বাধ্য হবে। "যার'-"তার' উপর ইলেক চড়াও নি ব'লে তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। পাছে হল (লাঙল) এবং হল (হইল) শব্দে অর্থ নিয়ে ফৌজদারি হয় সেজন্যে ইলেকের বাঁকা বুড়ো আঙুল না দেখিয়ে অকপটচিত্তে হোলো লিখতে দোষ কী। এ ক্ষেত্রে ঐ ইলেকের ইশারাটার কী মানে তা সকলের তো জানা নেই। হোলো শব্দে দুটো ওকার ধ্বনি আছে-- এক ইলেক কি ঐ দুটো অবলাকেই অন্তঃপুরে অবগুণ্ঠিত করেছেন। হতে ক্রিয়াপদ যে-অর্থ স্বভাবতই বহন করে তা ছাড়া আর কোনো অর্থ তার পরে আরোপ করা বঙ্গভাষায় সম্ভব কি না জানি নে অথচ ঐ ভালোমানুষ দাগীরূপে চিহ্নিত করা ওর কোন্‌ নিয়তির নির্দেশে। স্তম্ভপরে পালঙ্কপরে প্রভৃতি শব্দ কানে শোনবার সময় কোনো বাঙালির ছেলে ইলেকের অভাবে বিপন্ন হয় না, পড়বার সময়েও স্তম্ভ পালঙ্ক প্রভৃতি শব্দকে দিন মুহূর্ত প্রভৃতি কালার্থক শব্দ বলে কোনো প্রকৃতিস্থ লোকের ভূল করবার আশঙ্কা নেই। "চলবার' "বলবার' মরবার' "ধরবার' শব্দগুলি বিকল্পে দ্বিতীয় কোনো অর্থ নিয়ে কারবার করে না তবু তাদের সাধুত্ব রক্ষার জন্যে লেজগুটোনো ফোঁটার ছাপ কেন। তোমার প্রুফে দেখলুম "হয়ে' শব্দটা বিনা চিহ্নে সমাজে চলে গেল অথচ "ল'য়ে' কথাটাকে ইলেক দিয়ে লজ্জিত করেছ। পাছে সংগীতের লয় শব্দটার অধিকারভেদ নিয়ে মামলা বাধে এইজন্যে। কিন্তু সে রকম সুদূর সম্ভাবনা আছে কি। লাখে যদি একটা সম্ভাবনা থাকে তারি জন্যে কি হাজার হাজার নিরপরাধকে দাগা দেবে। কোন্‌ জায়গায় এরকম বিপদ ঘটতে পারে তার নমুনা আমাকে পাঠিয়ে দিয়ো। যেখানে যুক্ত ক্রিয়াপদে অসমাপিকা থাকে সেখানে তার অসমাপ্তি সম্বন্ধে কোনো দ্বিধা থাকতে পারে না। যেমন, বলে ফেলো, করে দাও ইত্যাদি। অবশ্য করে দাও মানে হাতে দাও হতেও পারে কিন্তু সমগ্র বাক্যের যোগে সে রকম অর্থবিকল্প হয় না-- যেমন কাজ করে দাও। "বলে ফেলো' কথাটাকে খণ্ডিত করে দেখলে আর-একটা মানে কল্পনা করা যায়, কেউ-একজন বলে, "ফেলো'। কিন্তু আমরা তো সব প্রথমভাগ বর্ণপরিচয়ের টুকরো কথার ব্যবসায়ী নই। "তুমি বলে যাও' কথাটা স্বতই স্পষ্ট, কেবল দুর্দৈবক্রমে, তুমি বল্‌ নাচে যাও এমন মানে হতেও পারে-- সেই ক্কচিৎ দুর্যোগ এড়াবার জন্যে eternal punishment কি দয়া কিংবা ন্যায়ের পরিচায়ক। "দেবতা নিশ্বাস ছাড়ি কহিলেন--' সমস্ত বাংলা দেশে যত পাঠশালায় যত ছেলে আছে পরীক্ষা করে দেখো একজনেরও ইলেকের দরকার হয় কি না, তবে কেন তুমি না-হক মুদ্রাকরকে পীড়িত করলে। তোমার প্রুফে তুমি ক্ষুদে ক্ষুদে চিহ্নের ঝাঁকে আমার কাব্যকে এমনি আচ্ছন্ন করেছ যে তাদের জন্য মশারি ফেলতে ইচ্ছে হয়। আবার প্রুফে আমি এর একটাও ব্যবহার করি নি-- কেননা, জানি বুঝতে কানাকড়ি পরিমাণেও বাধে না। জানি আমার বইয়ে নানা বানানে চিহ্নপ্রয়োগের নানা বৈচিত্র্য ঘটেছে-- তা নিয়েও আমি মাথা বকাই নে-- যেখানে দেখি অর্থবোধে বিপত্তি ঘটে সেখানে ছাড়া এইদিকে আমি দৃক্‌পাতও করি নে। প্রুফে যত অনাবশ্যক সংশোধন বাড়াবে ভুলের সম্ভাবনা ততই বাড়বে-- সময় নষ্ট হবে, তার বদলে লাভ কিছুই হবে না। ততো যতো শব্দে ওকার নিতান্ত অসংগত। মতো সম্বন্ধে অন্য ব্যবস্থা। মোটের উপর আমার বক্তব্য এই-- পাঠককে গোড়াতেই পাগল নির্বোধ কিংবা আহেলাবেলাতি বলে ধরে নিয়ো না-- যেখানে তাদের ভুল করবার কোনো সম্ভাবনা নেই সেখানে কেবলই তাদের চোখে আঙুল দিয়ো না-- চাণক্যের মতো চিহ্নের কুশাঙ্কুরগুলো উৎপাটিত কোরো তা হলে বানানভীরু শিশুদের যিনি বিধাতা তাঁর আশীর্বাদ লাভ করবে।

আমি যে নির্বিচারে চিহ্নসূয়যজ্ঞের জনমেজয়গিরি করতে বসেছি তা মনে কোরো না। কোনো কোনো স্থলে হাইফেন চিহ্নটার প্রয়োজন স্বীকার করি। অব্যয় "যে' এবং সর্বনাম "যে' শব্দের প্রয়োগভেদ বোঝাবার জন্যে আমি হাইফেনের শরণাপন্ন হই। "তুমি যে কাজে লেগেছ' বলতে বোঝায় তুমি অকর্মণ্য নও, এখানে "যে' অব্যয়। "তুমি যে কাজে লেগেছ' এখানে কাজকে নির্দিষ্ট করবার জন্য "যে' সর্বনাম বিশেষণ। প্রথম "যে' শব্দে হাইফেন দিয়ে "তুমি'-র সঙ্গে ও দ্বিতীয় "যে'-কে "কাজ' শব্দের সঙ্গে যুক্ত করলে অর্থ স্পষ্ট হয়। অন্যত্র দেখো-- "তিনি বললেন যে আপিসে যাও, সেখানে ডাক পড়েছে'। এখানে "যে' অব্যয়। অথবা তিনি বললেন "যে আপিসে যাও সেখানে ডাক পড়েছে।' এখানে "যে' সর্বনাম, আপিসের বিশেষণ। হাইফেন চিহ্নে অর্থভেদ স্পষ্ট করা যায়। যথা, "তিনি বললেন-যে আপিসে যাও, সেখানে ডাক পড়েছে।' এবং "তিনি বললেন যে-আপিসে যাও সেখানে ডাক পড়েছে।'

৮ ডিসেম্বর, ১৯৩২
1 | 2 | 3