পঁহু শব্দ বন্ধু শব্দ হইতে উৎপন্ন হয় নাই ইহা আপনি স্বীকার করেন, তথাপি উক্ত শব্দ যে প্রভুশব্দমূলক তাহা আপনার সংগত বোধ হয় না। কিন্তু পঁহু যে তৎসম বা তদ্‌ভব সংস্কৃত শব্দ নহে পরন্তু দেশজ শব্দ, আপনার এরূপ অনুমানের পক্ষে কোনো উপযুক্ত কারণ দেখাইতে পারেন নাই। কেবল আপনি বলিয়াছেন, "মধুররসসর্বস্ব পরকীয়া প্রেমে দাস্যভাব অসংযুক্ত।" কিন্তু এই একমাত্র যুক্তি আমার নিকট যথেষ্ট প্রবল বোধ হয় না; কারণ, বৈষ্ণবপদাবলীতে অনেক স্থানেই রাধিকা আপনাকে কৃষ্ণের দাসী ও কৃষ্ণ আপনাকে রাধিকার দাস বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন।

দ্বিতীয় কথা এই যে, পদাবলীতে স্থানে স্থানে পঁহু শব্দ প্রভু অথবা বঁধু ছাড়াও অন্য অর্থে যে ব্যবহৃত হইয়াছে, তাহা আমরা দৃষ্টান্ত দ্বারা প্রমাণ করিতে পারি।

রাধামোহন দাস রাধিকার বিরহবর্ণনা করিতেছেন :

প্রেমগজদলন সহই না পারই জীবইতে করই ধিকার।

অন্তরগত তুহু নিরগত করইতে কত কত করত সঞ্চার।

অথির নয়ন শরঘাতে বিষম জ্বর ছটফট জলজ শয়ান।

রাধামোহন পঁহু কহই অপরূপ নহ যাহে লাগয়ে পাঁচবান।

অর্থাৎ শ্যামকে সম্বোধন করিয়া দূতী কহিতেছে :

প্রেমগজের দলন সহিতে না পারিয়া রাধিকা বাঁচিয়া থাকা ধিক্কারযোগ্য জ্ঞান করিতেছেন এবং অন্তর্গত তোমাকে নির্গত করিবার জন্য বিবিধ চেষ্টা করিতেছেন। তোমার অস্থির নয়নশরঘাতে বিষম জ্বরাতুর হইয়া বিরহিণী পদ্মশয়ন অবলম্বন করিয়াছেন। রাধামোহন কহিতেছেন, যাহাকে পঞ্চবান লাগে তাহার এরূপ আচরণ কিছুই অপরূপ নহে।

এ স্থলে পহুঁ শব্দের কী অর্থ হইতেছে। "রাধামোহনের প্রভু বলিতেছেন' এরূপ অর্থ অসংগত। কারণ, কৃষ্ণের মুখে এরূপ উত্তর নিতান্ত রসভঙ্গজনক। "রাধামোহন কহিতেছেন হে প্রভু' এরূপ অর্থও এ স্থলে ঠিক খাটে না; কারণ, সেরূপ অর্থ হইলে পঁহু শব্দ পরে বসিত-- তাহা হইলে কবি সম্ভবত "রাধামোহন কহে অপরূপ নহে পঁহু' এইরূপ শব্দবিন্যাস ব্যবহার করিতেন।

যুগলমূর্তি বর্ণনায় গোবিন্দদাস কহিতেছেন :

ও নব পদুমিনী সাজ,

ইহ মত্ত মধুকর রাজ।

ও মুখ চন্দ উজোর,

ইহ দিঠি লুবধ চকোর।

গোবিন্দদাস পহু ধন্দ,

অরুণ নিয়ড়ে পুন চন্দ।

এখানে ভণিতার অর্থ :

অরুণের নিকট চাঁদ দেখিয়া গোবিন্দদাসের ধাঁদা লাগিয়াছে।

গোবিন্দদাসের প্রভুর ধাঁদা লাগিয়াছে এ কথা বলা যায় না, কারণ তিনিই বর্ণনার বিষয়। এখানে পঁহু সম্বোধন পদ নহে তাহা পড়িলেই বুঝা যায়।

শ্যামের সেবাসমাপনান্তে রাধিকা সখীসহ গৃহে ফিরিতেছেন :

সখীগণ মেলি করল জয়কার,

শ্যামরু অঙ্গে দেয়ল ফুলহার।

নিজ মন্দিরে ধনী করল প্রয়াণ,

ঘন বনে রহল সুনাগর কান।

সখীগণ সঙ্গে রঙ্গে চলু গোরী,

মণিময় ভূষণে অঙ্গ উজোরি।

শঙ্খ শব্দ ঘন জয়জয় কার,

সুন্দর বদনে কবরী কেশভার।

হেরি মদন কত পরাভব পায়

গোবিন্দদাস পহু এহ রস গায়।

এখানেও পঁহু অর্থে প্রভু অথবা বঁধু অসংগত।

সুন্দর অপরূপ শ্যামরু চন্দ,

দোহত ধেনু করত কত ছন্দ।

গোধন গরজত বড়ই গভীর

ঘন ঘন দোহন করত যদুবীর।

গোরস ধীর ধীর বিরাজিত অঙ্গ,

তমালে বিথারল মোহিত রঙ্গ।

মুটকি মুটকি ভরি রাখত ধারি।

গোবিন্দদাস পঁহু করত নেহারি।

এখানে "গোবিন্দদাসের প্রভু নিরীক্ষণ করিতেছেন' এরূপ অর্থ হয় না; কারণ, পূর্বেই উক্ত হইয়াছে তিনি দোহনে নিযুক্ত।

বনি বনমালা আজানুলম্বিত

পরিমলে অলিকুল মাতি রহু।

বিম্বাধর পর মোহন মুরলী

গায়ত গোবিন্দদাস পঁহু।

এখানে "গোবিন্দদাসের প্রভু গান গাহিতেছেন' ঠিক হয় না : কারণ, তাঁহার মুখে মোহন মুরলী।

নিজ মন্দির যাই বৈঠল রসবতী

গুরুজন নিরখি আনন্দ।

শিরীষ কুসুম জিনি তনু অতি সুকোমল

ঢর ঢর ও মুখচন্দ।...

গৃহ নিজ কাজ সমাপল সখীজন

গুরুজন সেবন ফেলি।

গোবিন্দদাস পঁহু দীপ সায়াহ্ন

বেলি অবসান ভৈ গেলি।

এই পদে কেবল রাধিকার গৃহের কথা হইতেছে; তিনি ক্রমে ক্রমে গৃহকার্য এবং ভোজনাদি সমাধা করিলেন এবং সন্ধ্যা হইল-- কবি ইহাই দর্শন এবং বর্ণনা করিতেছেন। এখানে শ্যাম কোথায় যে তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিবেন যে, "হে গোবিন্দদাসের বঁধু, বেলা গেল সন্ধ্যা হল।'

আমি কেবল নির্দেশ করিতে চাহি যে, গোবিন্দদাসের এবং দুই-এক স্থলে রাধামোহন দাসের পদাবলীতে পঁহু পহুঁ বা পহু--প্রভু ও বঁধু অর্থে ব্যবহৃত হয় না। কী অর্থে হয় তাহা নিঃসংশয়ে বলা কঠিন।

কিন্তু প্রাচীন কাব্যসংগ্রহে বিদ্যাপতির নোটে অক্ষয়বাবু এক স্থলে পহু অর্থে পুনঃ লিখিয়াছেন। তাঁহার সেই অর্থ নিতান্ত অনুমানমূলক না মনে করিয়া আমরা তাহাই গ্রহণ করিয়াছি এবং দেখিয়াছি স্থানে স্থানে পহুঁ শব্দের পুনঃ অর্থ সংগত হয়। কিন্তু তথাপি স্থানে স্থানে "ভণে' অর্থ না করিয়া পুনঃ অর্থ করিলে ভাব অসম্পূর্ণ থাকে; যেমন, গোবিন্দদাস পঁহু দীপ সায়াহ্ন ইত্যাদি।

এই কারণে আমরা কিঞ্চিৎ দ্বিধায় পড়িয়া আছি। ভণহুঁ এবং পুনহুঁ এই দুই শব্দ হইতেই যদি পহুঁ-র উৎপত্তি হইয়া থাকে তবে স্থানভেদে এই দুই অর্থই স্বীকার করিয়া লওয়া যায়। কিন্তু স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, গোবিন্দদাস (এবং কদাচিৎ রাধামোহন) ছাড়া আর-কোনো বৈষ্ণব কবির পদাবলীতে পহুঁ শব্দ প্রয়োগের এরূপ গোলযোগ নাই। অতএব ইহার বিরুদ্ধে যদি অন্য কোনো দৃষ্টান্ত ও প্রমাণ না থাকে তবে অনুমান করা যাইতে পারে যে, এই শব্দ ব্যবহারে গোবিন্দদাসের বিশেষ একটু শৈথিল্য ছিল।

প্রসঙ্গক্রমে জিজ্ঞাসা করি; আপনি মিথিলা প্রচলিত বিদ্যাপতির পদ হইতে যে-সকল দৃষ্টান্ত উদ্‌ধৃত করিয়াছেন তাহাতে পহু শব্দে চন্দ্রবিন্দু প্রয়োগ দেখা যাইতেছে; এই চন্দ্রবিন্দু কি আপনি কোনো পুঁথিতে পাইয়াছেন। গ্রিয়ার্সন-প্রকাশিত গ্রন্থে কোথাও পঁহু দেখি নাই; এবং কিছুকাল পূর্বে যে হস্তলিখিত পুঁথি দেখিয়াছিলাম তাহাতে পহু ব্যতীত কুত্রাপি পহুঁ দেখি নাই।

১২৯৯
1 | 2