আজ আমাদের স্কুল খুলিয়াছে। শিক্ষকেরা সকলে এখানে আসিয়াছেন। যদু ও বিনোদ অনুপস্থিত। তাহারা অসুস্থ। সব ঘরগুলি চূণকাম করা হইয়াছে। এখন আমি আমার নিজের কাজ করি। ঘর ঝাঁট দিই, বিছানা করি ও নিজের কাপড় ধুই। এটা আমার বেশ লাগে। আমাদের নতুন একজন ভূগোলের শিক্ষক আসিয়াছেন। তিনি খুব হাসিখুশি। ছেলেদের খুব ভালবাসেন, কখনও রাগ করেন না। তিনি আজ বিকেলে আমাদের আফ্রিকার বন্য পশুপাখীর ছবি দেখাইবেন। তাহার মধ্যে অনেক ভয়ঙ্কর জানোয়ারের ছবি আছে। অঙ্কের মাষ্টারমশায় আগামী কাল আসিবেন। তিনি বড় কড়া লোক। সকলেই তাঁহাকে ভয় করে। তাড়াতাড়ি আমায় চিঠি লিখিয়ো। ইতি
সেবিকা অমিতা
দিদি–
কাল আমরা কোপাই নদীর পারে পিক্নিকে যাবো। ঠাকুর চাকর সঙ্গে যাবে না, আমরা নিজেরাই রান্না করব। চাল ডাল তরকারী তেল ঘি ও মস্লা সবই আজ সকালবেলা কিনেছি। আমরা সবশুদ্ধ (all together) একুশ জন। একটা গরুর গাড়ি ভাড়া করেছি। সেটা কাল খুব সকালে আসবে। জিনিসপত্র সেটায় তুলে দেব। আমরা হেঁটে যাব। অনেক দূর যখন যাই তখন আমরা গান করি। তাই আমরা ক্লান্ত হই না। আমার বন্ধু শান্তি খুব ভালো গান করে। সেও আমাদের সঙ্গে যাবে। আমার গলা ভাঙা। এখন সন্ধ্যা ৯টা বেজেছে। শুতে যাচ্ছি। কাল খুব ভোরে উঠব। ইতি
স্নেহের বীণা
মা,
এখন এখানে বেশ শীত। বড়দিনের ছুটিতে এখানে মেলা হবে। অনেক লোক জড়ো হয়। কেউ কাছ থেকে আসে, কেউ বা অনেক দূরের। মেলা দু-দিন ধ’রে হয়। অনেকে প্রথন দিন বাড়ি ফেরে না। তারা পাশের গ্রাম থেকে শুক্নো খড় নিয়ে আসে। তাই রাত্রে মাটিতে বিছায়। তার উপরে শুয়ে রাত কাটায়। ওদের কেন অসুখ হয় না? কখনও বা ওরা দিনের বেলায় শুক্নো ডাল ও গাছের গুঁড়ি সংগ্রহ ক’রে রাখে। রাত্রে আগুন জ্বালায়। আগুনের চারি দিকে ঘিরে বসে। দোকানগুলো সারারাত খোলা থাকে। একদল স্বেচছাব্রতী (volunteer) মেলা পাহাড়া দেয়।
তুমি ও রাণী এবার এসো। আমার গরম শালটা সঙ্গে এনো। আমি ষ্টেশনে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব। ইতি–
প্রণতা উমা
ওরে তোরা কি জানিস্ কেউ
লেজ কেন ওঠে এত ঢেউ!
ওরা দিবস রজনী নাচে ।
তাহা শিখেছে কাহার কাছে ?
ওরা কারে ডাকে বাহু তুলে ,
ওরা কার কোলে ব'সে দুলে ?
আমি ব'সে ব'সে তাই ভাবি –
নদী কোথা হতে এল নাবি ?
কোথায় পাহাড়-সে কোন্খানে ,
তাহার নাম কি কেহই জানে ?
কেহ যেতে পারে তার কাছে ?
সেথায় মানুষ কি কেউ আছে ?
সেথা নাহি তরু নাহি ঘাস ,
নাহি পশু-পাখীদের বাস ।
সেথা রাশি রাশি মেঘ যত
থাকে ঘরের ছেলের ( children of the house ) মতো ।
সেথায় বাস করে শিং-তোলা ( upraised horns )
যত বুনো ছাগ দাড়িঝোলা ( with hanging beard ) ।
সেথায় মানুষ নূতনতরো –
তাদের শরীর ( limbs ) কঠিন বড়ো ,
তাদের চোখ দুটো নয় সোজা ,
তাদের কথা নাহি যায় বোঝা ,
তারা পাহাড়ের ছেলেমেয়ে
সদাই কাজ করে গান গেয়ে ,
তারা সারা দিনমান খেটে
আনে বোঝাভরা কাঠ কেটে ,
তারা চড়িয়া শিখর ( mountaintop )- 'পরে
বনের ( wild ) হরিণ শিকার করে ।
শেষে পাহাড় ছাড়িয়া এসে
নদী পড়ে বাহিরের দেশে ।
কোথাও চাষীরা করিতে চাষ ( till ) ,
কোথাও গরুতে খেতেছে ঘাস ।
কোথাও বৃহৎ অশথ গাছে
পাখি শিস দিয়ে দিয়ে নাচে ।
কোথাও রাখাল ছেলের দলে
খেলা করিছে গাছের তলে ।
সেথা মহিষের দল থাকে
তারা লুটায় (wallow ) নদীর পাঁকে ।
যত বুনো বরা সেথা ফেরে ,
তারা দাঁত ( tusk ) দিয়ে মাটি চেরে ।
সেথা শেয়াল লুকায়ে থাকে
রাতে হুয়া হুয়া ক'রে ডাকে ।
যেদিন পূরণিমা রাত আসে
চাঁদ আকাশ জুড়িয়া হাসে –
সবাই ঘুমায় কুটীরতলে ,
তরী একটিও নাহি চলে ,
গাছে পাতাটিও নাহি নড়ে
জলে নাহি ঢেউ ওঠে পড়ে ।
হোথায় গহন গভীর বন
তাহে নাহি লোক নাহি জন ,
শুধু কুমীর নদীর ধারে
সুখে রোদ পোহাইছে পাড়ে ।
বাঘ ফিরিতেছে ঝোপে ঝাপে ,
ঘাড়ে পড়ে আসি এক লাফে ।
কোথায় দেখা যায় চিতা বাঘ ,
তাহার গায়ে চাকা চাকা দাগ ।
সূর্য্য পশ্চিমে অস্ত যায়। গাছের তলায় অন্ধকার। পুকুরের জল কালো দেখাচ্ছে। বুড়ী নদীর ধারে চুপড়ি নিয়ে শাক তুলছে। হাট থেকে কানাই ফিরে আসে। চাষীরা মাঠের থেকে ফিরে আস্ছে। সন্ধ্যার তারা জ্বল্ছে। ছেলেরা তাদের মার কাছে এল। মন্দিরে ঘন্টা বাজছে। মেয়েরা ঘরের দুয়ারে প্রদীপ জ্বালল। পাখিরা বাসায় ফিরে এসেছে। শেয়ালগুলো জঙ্গলে ডাক্ছে। বাদুরগুলো দলে দলে উড়ে চলেছে।
ঘণ্টা বাজছে? রেবা, তোমার জলখাবার শেষ হয়েছে? আরে দেরী ক’রো না। চলো, আমরা যাই। সব বই নিয়েচ? পেন্সিল কোথায়? তাড়াতাড়ি হাঁটো। ঐ যে ছেলেমেয়েরা সব বসেছে। মাষ্টারমশায় এখনো আসেন নি। তবে তাড়াতাড়ি ক’রো না। অঙ্কটা শেষ করেছ? কেন, কাল সন্ধ্যায় বেড়াতে গিয়েছিলে? তোমার মাসী এসেছেন? আমারও অঙ্কটা শক্ত লাগল। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেছিলাম। ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চলো, মাষ্টারমশায়ের ডান দিকে বসি। এ দিক্টায় একটু পরেই রোদ আস্বে। তোমার শীত করছে না? আমার শীতের হাওয়ায় কাঁপুনি ধরেছে। উঠে দাঁড়াও, ঐ যে মাষ্টারমশায় আসছেন।
–
যদু, আর সবাই কোথায়? তারা সব তৈরি, এসো মালগুলি গাড়ীতে ওঠানো যাক্। গাড়োয়ানকে ডাকো। আর সময় নেই। ঐ যে সবাই আস্ছে। চলো, হেঁটে ষ্টেশনে যাওয়া যাক্। ষ্টেশন বেশি দূর নয়। আধ ঘণ্টায় পৌঁছাতে পারব। মধু, জিনিষগুলি গুণে নাও, এই নাও গাড়ীভাড়া। তোমরা এগুলো প্লাট্ফর্মে বয়ে নিয়ে যেয়ো, কুলি ডেকো না। তোমাদের ট্রেন-ভাড়া আমায় দাও, আমি সবার জন্য টিকেট কিনব। কী ভিড়! লোকগুলো বোকার মতো কেন ঠেলাঠেলি করে! আমায় কল্কাতার সাতখানা টিকেট দেবেন। গাড়ী আস্ছে, ঘণ্টা বেজে গেছে।