বিসর্জ্জন

আজিও পড়িছে ওই সেই সে নির্ঝর!

হিমাদ্রির বুকে বুকে শৃঙ্গে শৃঙ্গে ছুটে সুখে,

সরসীর বুকে পড়ে ঝর ঝর ঝর।

আজিও সে শৈলবালা বিস্তারিয়া ঊর্ম্মিমালা,

চলিছে কত কি কহি আপনার মনে!

তুষারশীতল বায় পুষ্প চুমি চুমি যায়,

খেলা করে মনোসুখে তটিনীর সনে।

কুটীর তটিনীতীরে লতারে ধরিয়া শিরে

মুখছায়া দেখিতেছে সলিলদর্পণে!

হরিণেরা তরুছায়ে খেলিতেছে গায়ে গায়ে,

চমকি হেরিছে দিক পাদপকম্পনে।

বনের পাদপপত্র আজিও মানবনেত্র

হিংসার অনলময় করে নি লোকন!

কুসুম লইয়া লতা প্রণত করিয়া মাথা

মানবেরে উপহার দেয় নি কখন!

বনের হরিণগণে মানবের শরাসনে

ছুটে ছুটে ভ্রমে নাই তরাসে তরাসে!

কানন ঘুমায় সুখে নীরব শান্তির বুকে,

কলঙ্কিত নাহি হোয়ে মানবনিশ্বাসে।

কমলা বসিয়া আছে উদাসিনী বেশে

শৈলতটিনীর তীরে এলোথেলো কেশে

অধরে সঁপিয়া কর, অশ্রু বিন্দু ঝর ঝর

ঝরিছে কপোলদেশে-- মুছিছে আঁচলে।

সম্বোধিয়া তটিনীরে ধীরে ধীরে বলে,

"তটিনী বহিয়া যাও আপনার মনে!

কিন্তু সেই ছেলেবেলা যেমন করিতে খেলা

তেমনি করিয়ে খেলো নির্ঝরের সনে!

তখন যেমন স্বরে কল কল গান করে

মৃদু বেগে তীরে আসি পড়িতে লো ঝাঁপি

বালিকা ক্রীড়ার ছলে পাথর ফেলিয়া জলে

মারিতাম-- জলরাশি উঠিত লো কাঁপি

তেমনি খেলিয়ে চল্‌ তুই লো তটিনীজল!

তেমনি বিতরি সুখ নয়নে আমার।

নির্ঝর তেমনি কোরে ঝাঁপিয়া সরসী-'পরে

পড়্‌ লো উগরি শুভ্র ফেনরাশিভার!

মুছিতে লো অশ্রুবারি এয়েছি হেথায়।

তাই বলি পাপিয়ারে! গান কর্‌ সুধাধারে

নিবাইয়া হৃদয়ের অনলশিখায়!

ছেলেবেলাকার মত বায়ু তুই অবিরত

লতার কুসুমরাশি কর্‌ লো কম্পিত!

নদী চল্‌ দুলে দুলে! পুষ্প দে হৃদয় খুলে!

নির্ঝর সরসীবক্ষ কর্‌ বিচলিত!

সেদিন আসিবে আর হৃদিমাঝে যাতনার

রেখা নাই, প্রমোদেই পূরিত অন্তর!

ছুটাছুটি করি বনে বেড়াইব ফুল্লমনে,

প্রভাতে অরুণোদয়ে উঠিব শিখর!

মালা গাঁথি ফুলে ফুলে জড়াইব এলোচুলে,

জড়ায়ে ধরিব গিয়ে হরিণের গল!

বড় বড় দুটি আঁখি মোর মুখপানে রাখি

এক দৃষ্টে চেয়ে রবে হরিণ বিহ্বল!

সেদিন গিয়েছে হা রে-- বেড়াই নদীর ধারে

ছায়াকুঞ্জে শুনি গিয়ে শুকদের গান!

না থাক্‌, হেথায় বসি, কি হবে কাননে পশি--

শুক আর গাবে নাকো খুলিয়ে পরাণ!

সেও যে গো ধরিয়াছে বিষাদের তান!

জুড়ায়ে হৃদয়ব্যথা দুলিবে না পুষ্পলতা,

তেমন জীবন্ত ভাবে বহিবে না বায়!

প্রাণহীন যেন সবি-- যেন রে নীরব ছবি--

প্রাণ হারাইয়া যেন নদী বহে যায়!

তবুও যাহাতে হোক্‌ নিবাতে হইবে শোক,

তবুও মুছিতে হবে নয়নের জল!

তবুও ত আপনারে ভুলিতে হইবে হা রে!

তবুও নিবাতে হবে হৃদয়-অনল!

যাই তবে বনে বনে ভ্রমিগে আপনমনে,

যাই তবে গাছে গাছে ঢালি দিই জল!

শুকপাখীদের গান শুনিয়া জুড়াই প্রাণ,

সরসী হইতে তবে তুলিগে কমল!

হৃদয় নাচে না ত গো তেমন উল্লাসে!

ভ্রমিত ভ্রমিই বনে ম্রিয়মাণ শূন্যমনে,

দেখি ত দেখিই বোসে সলিল-উচ্ছ্বাসে!

তেমন জীবন্ত ভাব নাই ত অন্তরে--

দেখিয়া লতার কোলে ফুটন্ত কুসুম দোলে,

কুঁড়ি লুকাইয়া আছে পাতার ভিতবে--

নির্ঝরের ঝরঝরে হৃদয়ে তেমন কোরে

উল্লাসে শোণিতরাশি উঠে না নাচিয়া!

কি জানি কি করিতেছি, কি জানি কি ভাবিতেছি,

কি জানি কেমনধারা শূন্যপ্রায় হিয়া!

তবুও যাহাতে হোক্‌ নিবাতে হইবে শোক,

তবুও মুছিতে হবে নয়নের জল।

তবুও ত আপনারে ভুলিতে হইবে হা রে,

তবুও নিবাতে হবে হৃদয়-অনল!

কাননে পশিগে তবে শুক যেথা সুধারবে

গান করে জাগাইয়া নীরব কানন।

উঁচু করি করি মাথা হরিণেরা বৃক্ষপাতা

সুধীরে নিঃশঙ্কমনে করিছে চর্ব্বণ!"

সুন্দরী এতেক বলি পশিল কাননস্থলী,

পাদপ রৌদ্রের তাপ করিছে বারণ।

বৃক্ষছায়ে তলে তলে ধীরে ধীরে নদী চলে

সলিলে বৃক্ষের মূল করি প্রক্ষালন।

হরিণ নিঃশঙ্কমনে শুয়ে ছিল ছায়াবনে,

পদশব্দ পেয়ে তারা চমকিয়া উঠে।

বিস্তারি নয়নদ্বয় মুখপানে চাহি রয়,

সহসা সভয় প্রাণে বনান্তরে ছুটে।

ছুটিছে হরিণচয়, কমলা অবাক্‌ রয়--

নেত্র হতে ধীরে ধীরে ঝরে অশ্রুজল।

ওই যায়-- ওই যায় হরিণ হরিণী হায়--

যায় যায় ছুটে ছুটে মিলি দলে দল।

কমলা বিষাদভরে কহিল সমুচ্চস্বরে--

প্রতিধ্বনি বন হোতে ছুটে বনান্তরে--

"যাস্‌ নে-- যাস্‌ নে তোরা, আয় ফিরে আয়!

কমলা-- কমলা সেই ডাকিতেছে তোরে!

সেই যে কমলা সেই থাকিত কুটীরে,

সেই যে কমলা সেই বেড়াইত বনে!

সেই যে কমলা পাতা ছিঁড়ি ধীরে ধীরে

হরষে তুলিয়া দিত তোদের আননে!

কোথা যাস্‌-- কোথা যাস্‌-- আয় ফিরে আয়!

ডাকিছে তোদের আজি সেই সে কমলা!

কারে ভয় করি তোরা যাস্‌ রে কোথায়?

আয় হেথা দীর্ঘশৃঙ্গ! আয় লো চপলা!

এলি নে-- এলি নে তোরা এখনো এলি নে--

কমলা ডাকিছে যে রে,তবুও এলি নে!

ভুলিয়া গেছিস্‌ তোরা আজি কমলারে?

ভুলিয়া গেছিস্‌ তোরা আজি বালিকারে?

খুলিয়া ফেলিনু এই কবরীবন্ধন,

এখনও ফিরিবি না হরিণের দল?

এই দেখ্‌-- এই দেখ্‌ ফেলিয়া বসন

পরিনু সে পুরাতন গাছের বাকল!

যাক্‌ তবে, যাক্‌ চ'লে-- যে যায় যেখানে--

শুক পাখী উড়ে যাক্‌ সুদূর বিমানে!

আয়-- আয়-- আয় তুই আয় রে মরণ!

বিনাশশক্তিতে তোর নিভা এ যন্ত্রণা!

পৃথিবীর সাথে সব ছিঁড়িব বন্ধন!

বহিতে অনল হৃদে আর ত পারি না!

নীরদ স্বরগে আছে, আছেন জনক

স্নেহময়ী মাতা মোর কোল রাখি পাতি--

সেথায় মিলিব গিয়া, সেথায় যাইব--

ভোর করি জীবনের বিষাদের রাতি!

নীরদে আমাতে চড়ি প্রদোষতারায়

অস্তগামী তপনেরে করিব বীক্ষণ,

মন্দাকিনী তীরে বসি দেখিব ধরায়

এত কাল যার কোলে কাটিল জীবন।

শুকতারা প্রকাশিবে উষার কপোলে

তখন রাখিয়া মাথা নীরদের কোলে--

অশ্রুজলসিক্ত হয়ে কব সেই কথা

পৃথিবী ছাড়িয়া এনু পেয়ে কোন্‌ ব্যথা!

নীরদের আঁখি হোতে ব'বে অশ্রুজল!

মুছিব হরষে আমি তুলিয়া আঁচল!

আয়-- আয়-- আয় তুই, আয় রে মরণ!

পৃথিবীর সাথে সব ছিঁড়িব বন্ধন!"

এত বলি ধীরে ধীরে উঠিল শিখর!

দেখে বালা নেত্র তুলে--

চারি দিক গেছে খুলে

উপত্যকা, বনভূমি, বিপিন, ভূধর!

তটিনীর শুভ্র রেখা--

নেত্রপথে দিল দেখা--

বৃক্ষছায়া দুলাইয়া ব'হে ব'হে যায়!

ছোট ছোট গাছপালা--

সঙ্কীর্ণ নির্ঝরমালা--

সবি যেন দেখা যায় রেখা-রেখা-প্রায়।

গেছে খুলে দিগ্বিদিক--

নাহি পাওয়া যায় ঠিক

কোথা কুঞ্জ-- কোথা বন-- কোথায় কুটীর!

শ্যামল মেঘের মত--

হেথা হোথা কত শত

দেখায় ঝোপের প্রায় কানন গভীর!

তুষাররাশির মাঝে দাঁড়ায়ে সুন্দরী!

মাথায় জলদ ঠেকে,

চরণে চাহিয়া দেখে

গাছপালা ঝোপে-ঝাপে ভূধর আবরি!

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রেখা-রেখা

হেথা হোথা যায় দেখা

কে কোথা পড়িয়া আছে কে দেখে কোথায়!

বন, গিরি, লতা, পাতা আঁধারে মিশায়!

অসংখ্য শিখরমালা ব্যাপি চারি ধার--

মধ্যের শিখর-'পরে

(মাথায় আকাশ ধরে)

কমলা দাঁড়ায়ে আছে, চৌদিকে তুষার!

চৌদিকে শিখরমালা--

মাঝেতে কমলা বালা

একেলা দাঁড়ায়ে মেলি নয়নযুগল!

এলোথেলো কেশপাশ,

এলোথেলো বেশবাস,

তুষারে লুটায়ে পড়ে বসন-আঁচল!

যেন কোন্‌ সুরবালা

দেখিতে মর্ত্ত্যের লীলা

স্বর্গ হোতে নামি আসি হিমাদ্রিশিখরে

চড়িয়া নীরদ-রথে--

সমুচ্চ শিখর হোতে

দেখিলেন পৃথ্বীতল বিস্মিত অন্তরে!

তুষাররাশির মাঝে দাঁড়ায়ে সুন্দরী!

হিমময় বায়ু ছুটে,

অন্তরে অন্তরে ফুটে

হৃদয়ে রুধিরোচ্ছ্বাস স্তব্ধপ্রায় করি!

শীতল তুষারদল

কোমল চরণতল

দিয়াছে অসাড় ক'রে পাষাণের মত!

কমলা দাঁড়ায়ে আছে যেন জ্ঞানহত!

কোথা স্বর্গ-- কোথা মর্ত্ত্য-- আকাশ পাতাল!

কমলা কি দেখিতেছে!

কমলা কি ভাবিতেছে!

কমলার হৃদয়েতে ঘোর গোলমাল!

চন্দ্র সূর্য্য নাই কিছু--

শূন্যময় আগু পিছু!

নাই রে কিছুই যেন ভূধর কানন!

নাইক শরীর দেহ,

জগতে নাইক কেহ--

একেলা রয়েছে যেন কমলার মন!

কে আছে-- কে আছে-- আজি কর গো বারণ!

বালিকা ত্যজিতে প্রাণ করেছে মনন!

বারণ কর গো তুমি গিরি হিমালয়!

শুনেছ কি বনদেবী-- করুণা-আলয়--

বালিকা তোমার কোলে করিত ক্রন্দন,

সে নাকি মরিতে আজ করেছে মনন?

বনের কুসুমকলি

তপনতাপনে জ্বলি

শুকায়ে মরিবে নাকি করেছে মনন!

শীতল শিশিরধারে

জীয়াও জীয়াও তারে

বিশুষ্ক হৃদয়মাঝে বিতরি জীবন!

উদিল প্রদোষতারা সাঁঝের আঁচলে--

এখনি মুদিবে আঁখি?

বারণ করিবে না কি?

এখনি নীরদকোলে মিশাবে কি বোলে?

অনন্ত তুষারমাঝে দাঁড়ায়ে সুন্দরী!

মোহস্বপ্ন গেছে ছুটে--

হেরিল চমকি উঠে

চৌদিকে তুষাররাশি শিখর আবরি!

উচ্চ হোতে উচ্চ গিরি

জলদে মস্তক ঘিরি

দেবতার সিংহাসন করিছে লোকন!

বনবালা থাকি থাকি

সহসা মুদিল আঁখি

কাঁপিয়া উঠিল দেহ! কাঁপি উঠে মন!

অনন্ত আকাশমাঝে একেলা কমলা!

অনন্ত তুষারমাঝে একেলা কমলা!

সমুচ্চ শিখর-'পরে একেলা কমলা!

আকাশে শিখর উঠে

চরণে পৃথিবী লুটে--

একেলা শিখর-'পরে বালিকা কমলা!

ওই-- ওই-- ধর্‌-- ধর্‌-- পড়িল বালিকা!

ধবলতুষারচ্যুতা পড়িল বিহ্বল!--

খসিল পাদপ হোতে কুসুমকলিকা!

খসিল আকাশ হোতে তারকা উজ্জ্বল!

প্রশান্ত তটিনী চলে কাঁদিয়া কাঁদিয়া!

ধরিল বুকের পরে কমলাবালায়!

উচ্ছ্বাসে সফেন জল উঠিল নাচিয়া!

কমলার দেহ ওই ভেসে ভেসে যায়!

কমলার দেহ বহে সলিল-উচ্ছ্বাস!

কমলার জীবনের হোলো অবসান!

ফুরাইল কমলার দুখের নিঃশ্বাস,

জুড়াইল কমলার তাপিত পরাণ!

কল্পনা! বিষাদে দুখে গাইনু সে গান!

কমলার জীবনের হোলো অবসান!

দীপালোক নিভাইল প্রচণ্ড পবন!

কমলার-- প্রতিমার হ'ল বিসর্জ্জন!
1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 | 9