গুরু রামানন্দ স্তব্ধ দাঁড়িয়ে

গঙ্গার জলে পূর্বমুখে।

তখন জলে লেগেছে সোনার কাঠির ছোঁওয়া,

ভোরের হাওয়ায় স্রোত উঠছে ছল্‌ছল্‌ করে।

রামানন্দ তাকিয়ে আছেন

জবাকুসুমসঙ্কাশ সূর্যোদয়ের দিকে।

মনে মনে বলছেন,

"হে দেব, তোমার যে কল্যাণতম রূপ

সে তো আমার অন্তরে প্রকাশ পেল না।

ঘোচাও তোমার আবরণ।'

সূর্য উঠল শালবনের মাথার উপর।

জেলেরা নৌকায় পাল দিলে তুলে,

বকের পাঁতি উড়ে চলেছে সোনার আকাশ বেয়ে

ও পারে জলার দিকে।

এখনো স্নান হল না সারা।

শিষ্য শুধালো, "বিলম্ব কেন প্রভু,

পূজার সময় যায় বয়ে।'

রামানন্দ উত্তর করলেন,

"শুচি হয় নি তনু,

গঙ্গা রইলেন আমার হৃদয় থেকে দূরে।'

শিষ্য বসে ভাবে, এ কেমন কথা।

সর্ষেখেতে রৌদ্র ছড়িয়ে গেল।

মালিনী খুলেছে ফুলের পসরা পথের ধারে,

গোয়ালিনী যায় দুধের কলস মাথায় নিয়ে।

গুরুর কী হল মনে,

উঠলেন জল ছেড়ে।

চললেন বনঝাউ ভেঙে

গাঙশালিকের কোলাহলের মধ্য দিয়ে।

শিষ্য শুধালো, "কোথায় যাও প্রভু,

ও দিকে তো নেই ভদ্রপাড়া।'

গুরু বললেন, "চলেছি স্নানসমাপনের পথে।'

বালুচরের প্রান্তে গ্রাম।

গলির মধ্যে প্রবেশ করলেন গুরু।

সেখানে তেঁতুল গাছের ঘন ছায়া,

শাখায় শাখায় বানরদলের লাফালাফি।

গলি পৌঁছয় ভাজন মুচির ঘরে।

পশুর চামড়ার গন্ধ আসছে দূর থেকে।

আকাশে চিল উড়ছে পাক দিয়ে,

রোগা কুকুর হাড় চিবোচ্ছে পথের পাশে।

শিষ্য বললে, "রাম! রাম!'

ভ্রূকুটি করে দাঁড়িয়ে রইল গ্রামের বাইরে।

ভাজন লুটিয়ে পড়ে গুরুকে প্রণাম করলে

সাবধানে।

গুরু তাকে বুকে নিলেন তুলে।

ভাজন ব্যস্ত হয়ে উঠল,

"কী করলেন প্রভু,

অধমের ঘরে মলিনের গ্লানি লাগল পুণ্যদেহে।'

রামানন্দ বললেন,

"স্নানে গেলেম তোমার পাড়া দূরে রেখে,

তাই যিনি সবাইকে দেন ধৌত করে

তাঁর সঙ্গে মনের মিল হল না।

এতক্ষণে তোমার দেহে আমার দেহে

বইল সেই বিশ্বপাবনধারা।

ভগবান সূর্যকে আজ প্রণাম করতে গিয়ে প্রণাম বেধে গেল।

বললেম, হে দেব, তোমার মধ্যে যে জ্যোতি আমার মধ্যেও তিনি,

তবু আজ দেখা হল না কেন।

এতক্ষণে মিলল তাঁর দর্শন

তোমার ললাটে আর আমার ললাটে--

মন্দিরে আর হবে না যেতে।'