অয়ি সন্ধ্যে,

অনন্ত আকাশতলে বসি একাকিনী,

কেশ এলাইয়া

মৃদু মৃদু ও কী কথা কহিস আপন মনে

গান গেয়ে গেয়ে,

নিখিলের মুখপানে চেয়ে।

প্রতিদিন শুনিয়াছি, আজও তোর কথা

নারিনু বুঝিতে।

প্রতিদিন শুনিয়াছি, আজও তোর গান

নারিনু শিখিতে।

চোখে লাগে ঘুমঘোর,

প্রাণ শুধু ভাবে হয় ভোর।

হৃদয়ের অতিদূর দূর দূরান্তরে

মিলাইয়া কণ্ঠস্বর তোর কন্ঠস্বরে

উদাসী প্রবাসী যেন

তোর সাথে তোরি গান করে।

অয়ি সন্ধ্যা, তোরি যেন স্বদেশের প্রতিবেশী

তোরি যেন আপনার ভাই

প্রাণের প্রবাসে মোর দিশা হারাইয়া

বেড়ায় সদাই।

শোনে যেন স্বদেশের গান,

দূর হতে কার পায় সাড়া

খুলে দেয় প্রাণ।

যেন কী পুরোনো স্মৃতি

জাগিয়া উঠে রে ওই গানে।

ওই তারকার মাঝে যেন তার গৃহ ছিল,

হাসিত কাঁদিত ওইখানে।

আর বার ফিরে যেতে চায়

পথ তবু খুঁজি না পায়।

কত-না পুরানো কথা, কত-না হারানো গান,

কত না প্রাণের দীর্ঘশ্বাস,

শরমের আধো হাসি, সোহাগের আধো বাণী,

প্রণয়ের আধো মৃদু ভাষ,

সন্ধ্যা, তোর ওই অন্ধকারে

হারাইয়া গেছে একেবারে।

পূর্ণ করি অন্ধকার তোর

তারা সবে ভাসিয়া বেড়ায়

যুগান্তের প্রশান্ত হৃদয়ে

ভাঙাচোরা জগতের প্রায়।

যবে এই নদীতীরে বসি তোর পদতলে

তারা সবে দলে দলে আসে

প্রাণেরে ঘেরিয়া চারি পাশে;

হয়তো একটি হাসি একটি আধেক হাসি

সমুখেতে ভাসিয়া বেড়ায়,

কভু ফোটে কভু বা মিলায়।

আজি আসিয়াছি সন্ধ্যা, বসি তোর অন্ধকারে

মুদিয়া নয়ন

সাধ গেছে গাহিবারে--মৃদু স্বরে শুনাবারে

দু-চারিটি গান।

যেথায় পুরোনো গান যেথায় হারানো হাসি

যেথা আছে বিস্মৃত স্বপন

সেইখানে সযতনে রেখে দিস গানগুলি,

রচে দিস সমাধিশয়ন।

জানি সন্ধ্যা, জানি তোর স্নেহ,

গোপনে ঢাকিবি তার দেহ

বসিয়া সমাধি-'পরে নিষ্ঠুরকৌতুকভরে

দেখিস হাসে না যেন কেহ।

ধীরে শুধু ঝরিবে শিশির,

মৃদু শ্বাস ফেলিবে সমীর।

স্তব্ধতা কপোলে হাত দিয়ে

একা সেথা রহিবে বসিয়া,

মাঝে মাঝে দু-একটি তারা

সেথা আসি পড়িবে খসিয়া।