ছেলেটার বয়স হবে বছর দশেক--

পরের ঘরে মানুষ।

যেমন আগাছা বেড়ে ওঠে ভাঙা বেড়ার ধারে--

মালীর যত্ন নেই,

আছে আলোক বাতাস বৃষ্টি

পোকামাকড় ধুলোবালি--

কখনো ছাগলে দেয় মুড়িয়ে,

কখনো মাড়িয়ে দেয় গোরুতে--

তবু মরতে চায় না, শক্ত হয়ে ওঠে,

ডাঁটা হয় মোটা,

পাতা হয় চিকন সবুজ।

ছেলেটা কুল পাড়তে গিয়ে গাছের থেকে পড়ে,

হাড় ভাঙে,

বুনো বিষফল খেয়ে ওর ভির্মি লাগে,

রথ দেখতে গিয়ে কোথায় যেতে কোথায় যায়,

কিছুতেই কিছু হয় না--

আধমরা হয়েও বেঁচে ওঠে,

হারিয়ে গিয়ে ফিরে আসে

কাদা মেখে কাপড় ছিঁড়ে--

মার খায় দমাদম,

গাল খায় অজস্র--

ছাড়া পেলেই আবার দেয় দৌড়।

মরা নদীর বাঁকে দাম জমেছে বিস্তর,

বক দাঁড়িয়ে থাকে ধারে,

দাঁড়কাক বসেছে বৈঁচিগাছের ডালে,

আকাশে উড়ে বেড়ায় শঙ্খচিল,

বড়ো বড়ো বাঁশ পুঁতে জাল পেতেছে জেলে,

বাঁশের ডগায় বসে আছে মাছরাঙা,

পাতিহাঁস ডুবে ডুবে গুগলি তোলে।

বেলা দুপুর।

লোভ হয় জলের ঝিলিমিলি দেখে--

তলায় পাতা ছড়িয়ে শেওলাগুলো দুলতে থাকে,

মাছগুলো খেলা করে।

আরো তলায় আছে নাকি নাগকন্যা?

সোনার কাঁকই দিয়ে আঁচড়ায় লম্বা চুল,

আঁকাবাঁকা ছায়া তার জলের ঢেউয়ে।

ছেলেটার খেয়াল গেল ওইখানে ডুব দিতে--

ওই সবুজ স্বচ্ছ জল,

সাপের চিকন দেহের মতো।

"কী আছে দেখিই-না' সব তাতে এই তার লোভ।

দিল ডুব, দামে গেল জড়িয়ে--

চেঁচিয়ে উঠে, খাবি খেয়ে, তলিয়ে গেল কোথায়।

ডাঙায় রাখাল চরাচ্ছিল গোরু,

জেলেদের ডিঙি নিয়ে টানাটানি করে তুললে তাকে--

তখন সে নিঃসাড়।

তার পরে অনেক দিন ধরে মনে পড়েছে

চোখে কী করে সর্ষেফুল দেখে,

আঁধার হয়ে আসে,

যে মাকে কচি বেলায় হারিয়েছে

তার ছবি জাগে মনে,

জ্ঞান যায় মিলিয়ে।

ভারি মজা,

কী করে মরে সেই মস্ত কথাটা।

সাথিকে লোভ দেখিয়ে বলে,

"একবার দেখ্‌-না ডুবে, কোমরে দড়ি বেঁধে,

আবার তুলব টেনে।'

ভারি ইচ্ছা করে জানতে ওর কেমন লাগে।

সাথি রাজি হয় না;

ও রেগে বলে, "ভীতু, ভীতু, ভীতু কোথাকার।'

বক্সিদের ফলের বাগান, সেখানে লুকিয়ে যায় জন্তুর মতো।

মার খেয়েছে বিস্তর, জাম খেয়েছে আরো অনেক বেশি।

বাড়ির লোকে বলে, "লজ্জা করে না বাঁদর?'

কেন লজ্জা।

বক্সিদের খোঁড়া ছেলে তো ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে ফল পাড়ে,

ঝুড়ি ভরে নিয়ে যায়,

গাছের ডাল যায় ভেঙে,

ফল যায় দ'লে--

লজ্জা করে না?

একদিন পাকড়াশীদের মেজো ছেলে একটা কাঁচ-পরানো চোঙ নিয়ে

ওকে বললে, "দেখ্‌-না ভিতর বাগে।'

দেখল নানা রঙ সাজানো,

নাড়া দিলেই নতুন হয়ে ওঠে।

বললে, "দে-না ভাই, আমাকে।

তোকে দেব আমার ঘষা ঝিনুক,

কাঁচা আম ছাড়াবি মজা ক'রে--

আর দেব আমের কষির বাঁশি।'

দিল না ওকে।

কাজেই চুরি করে আনতে হল।

ওর লোভ নেই--

ও কিছু রাখতে চায় না, শুধু দেখতে চায়

কী আছে ভিতরে।

খোদন দাদা কানে মোচড় দিতে দিতে বললে,

"চুরি করলি কেন।'

লক্ষ্মীছাড়াটা জবাব করলে,

"ও কেন দিল না।'

যেন চুরির আসল দায় পাকড়াশিদের ছেলের।

ভয় নেই ঘৃণা নেই ওর দেহটাতে।

কোলাব্যাঙ তুলে ধরে খপ ক'রে,

বাগানে আছে খোঁটা পোঁতার এক গর্ত,

তার মধ্যে সেটা পোষে--

পোকামাকড় দেয় খেতে।

গুবরে পোকা কাগজের বাক্সোয় এনে রাখে,

খেতে দেয় গোবরের গুটি--

কেউ ফেলে দিতে গেলে অনর্থ বাধে।

ইস্কুলে যায় পকেটে নিয়ে কাঠবিড়ালি।

একদিন একটা হেলে সাপ রাখলে মাস্টারের ডেস্কে--

ভাবলে, "দেখিই-না কী করে মাস্টারমশায়।'

ডেক্‌সো খুলেই ভদ্রলোক লাফিয়ে উঠে দিলেন দৌড়--

দেখবার মতো দৌড়টা।

একটা কুকুর ছিল ওর পোষা,

কুলীনজাতের নয়,

একেবারে বঙ্গজ।

চেহারা প্রায় মনিবেরই মতো,

ব্যবহারটাও।

অন্ন জুটত না সব সময়ে,

গতি ছিল না চুরি ছাড়া--

সেই অপকর্মের মুখে তার চতুর্থ পা হয়েছিল খোঁড়া।

আর, সেইসঙ্গেই কোন্‌ কার্যকারণের যোগে

শাসনকর্তাদের শসাখেতের বেড়া গিয়েছিল ভেঙে।

মনিবের বিছানা ছাড়া কুকুরটার ঘুম হত না রাতে,

তাকে নইলে মনিবেরও সেই দশা।

একদিন প্রতিবেশীর বাড়া ভাতে মুখ দিতে গিয়ে

তার দেহান্তর ঘটল।

মরণান্তিক দুঃখেও কোনোদিন জল বেরোয় নি যে ছেলের চোখে

দু দিন সে লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদে কেঁদে বেড়ালো,

মুখে অন্নজল রুচল না,

বক্সিদের বাগানে পেকেছে করম্‌চা--

চুরি করতে উৎসাহ হল না।

সেই প্রতিবেশীদের ভাগ্নে ছিল সাত বছরের,

তার মাথার উপর চাপিয়ে দিয়ে এল এক ভাঙা হাঁড়ি।

হাঁড়ি-চাপা তার কান্না শোনালো যেন ঘানিকলের বাঁশি।

গেরস্তঘরে ঢুকলেই সবাই তাকে "দূর দূর' করে,

কেবল তাকে ডেকে এনে দুধ খাওয়ায় সিধু গয়লানী।

তার ছেলেটি মরে গেছে সাত বছর হল,

বয়সে ওর সঙ্গে তিন দিনের তফাত।

ওরই মতো কালোকোলো,

নাকটা ওইরকম চ্যাপ্টা।

ছেলেটার নতুন নতুন দৌরাত্মি এই গয়লানী মাসীর 'পরে।

তার বাঁধা গোরুর দড়ি দেয় কেটে,

তার ভাঁড় রাখে লুকিয়ে,

খয়েরের রঙ লাগিয়ে দেয় তার কাপড়ে।

"দেখি-না কী হয়' তারই বিবিধ-রকম পরীক্ষা।

তার উপদ্রবে গয়লানীর স্নেহ ওঠে ঢেউ খেলিয়ে।

তার হয়ে কেউ শাসন করতে এলে

সে পক্ষ নেয় ওই ছেলেটারই।

অম্বিকে মাস্টার আমার কাছে দুঃখ ক'রে গেল,

"শিশুপাঠে আপনার লেখা কবিতাগুলো

পড়তে ওর মন লাগে না কিছুতেই,

এমন নিরেট বুদ্ধি।

পাতাগুলো দুষ্টুমি ক'রে কেটে রেখে দেয়,

বলে ইঁদুরে কেটেছে।

এতবড়ো বাঁদর।'

আমি বললুম, "সে ত্রুটি আমারই,

থাকত ওর নিজের জগতের কবি

তা হলে গুবরে পোকা এত স্পষ্ট হত তার ছন্দে

ও ছাড়তে পারত না।

কোনোদিন ব্যাঙের খাঁটি কথাটি কি পেরেছি লিখতে,

আর সেই নেড়ি কুকুরের ট্রাজেডি।'