জন্মেছিনু সূক্ষ্ম তারে বাঁধা মন নিয়া,

চারি দিক হতে শব্দ উঠিত ধ্বনিয়া

নানা কম্পে নানা সুরে

নাড়ীর জটিল জালে ঘুরে ঘুরে।

বালকের মনের অতলে দিত আনি

পাণ্ডুনীল আকাশের বাণী

চিলের সুতীক্ষ্ণ সুরে

নির্জন দুপুরে,

রৌদ্রের প্লাবনে যবে চারি ধার

সময়েরে করে দিত একাকার

নিষ্কর্ম তন্দ্রার তলে।

ওপাড়ার কুকুরের সুদূর কলকোলাহলে

মনেরে জাগাত মোর অনির্দিষ্ট ভাবনার পারে

অস্পষ্ট সংসারে।

ফেরিওলাদের ডাক সূক্ষ্ম হয়ে কোথা যেত চলি,

যে-সকল অলিগলি

জানি নি কখনো

তারা যেন কোনো

বোগদাদের বসোরার

পরদেশী পসরার

স্বপ্ন এনে দিত বহি।

রহি রহি

রাস্তা হতে শোনা যেত সহিসের ডাক ঊর্ধ্বস্বরে,

অন্তরে অন্তরে

দিত সে ঘোষণা কোন্‌ অস্পষ্ট বার্তার,

অসম্পন্ন উধাও যাত্রার।

একঝাঁক পাতিহাঁস

টলোমলো গতি নিয়ে উচ্চকলভাষ

পুকুরে পড়িত ভেসে।

বটগাছ হতে বাঁকা রৌদ্ররশ্মি এসে

তাদের সাঁতার-কাটা জলে

সবুজ ছায়ার তলে

চিকন সাপের মতো পাশে পাশে মিলি

খেলাত আলোর কিলিবিলি।

বেলা হলে

হলদে গামছা কাঁধে হাত দোলাইয়া যেত চলে

কোন্‌খানে কে যে।

ইস্কুলে উঠিত ঘণ্টা বেজে।

সে ঘণ্টার ধ্বনি

নিরর্থ আহ্বানঘাতে কাঁপাইত আমার ধমনী।

রৌদ্রক্লান্ত ছুটির প্রহরে

আলস্যে-শিথিল শান্তি ঘরে ঘরে;

দক্ষিণে গঙ্গার ঘাট থেকে

গম্ভীরমন্দ্রিত হাঁক হেঁকে

বাষ্পশ্বাসী সমুদ্র-খেয়ার ডিঙা

বাজাইত শিঙা,

রৌদ্রের প্রান্তর বহি

ছুটে যেত দিগন্তে শব্দের অশ্বারোহী।

বাতায়নকোণে

নির্বাসনে

যবে দিন যেত বয়ে

না-চেনা ভুবন হতে ভাষাহীন নানা ধ্বনি লয়ে

প্রহরে প্রহরে দূত ফিরে ফিরে

আমারে ফেলিত ঘিরে।

জনপূর্ণ জীবনের যে আবেগ পৃথ্বীনাট্যশালে

তালে ও বেতালে

করিত চরণপাত,

কভু অকস্মাৎ

কভু মৃদুবেগে ধীরে

ধ্বনিরূপে মোর শিরে

স্পর্শ দিয়ে চেতনারে জাগাইত ধোঁয়ালি চিন্তায়,

নিয়ে যেত সৃষ্টির আদিম ভূমিকায়।

চোখে দেখা এ বিশ্বের গভীর সুদূরে

রূপের অদৃশ্য অন্তঃপুরে

ছন্দের মন্দিরে বসি রেখা-জাদুকর কাল

আকাশে আকাশে নিত্য প্রসারে বস্তুর ইন্দ্রজাল।

যুক্তি নয়, বুদ্ধি নয়,

শুধু যেথা কত কী যে হয়--

কেন হয় কিসে হয় সে প্রশ্নের কোনো

নাহি মেলে উত্তর কখনো।

যেথা আদিপিতামহী পড়ে বিশ্ব-পাঁচালির ছড়া

ইঙ্গিতের অনুপ্রাসে গড়া--

কেবল ধ্বনির ঘাতে বক্ষস্পন্দে দোলন দুলায়ে

মনেরে ভুলায়ে

নিয়ে যায় অস্তিত্বের ইন্দ্রজাল যেই কেন্দ্রস্থলে,

বোধের প্রত্যুষে যেথা বুদ্ধির প্রদীপ নাহি জ্বলে।