তখন একটা রাত-- উঠেছে সে তড়বড়ি,

কাঁচা ঘুম ভেঙে। শিয়রেতে ঘড়ি

কর্কশ সংকেত দিল নির্মম ধ্বনিতে।

অঘ্রানের শীতে

এ বাসার মেয়াদের শেষে

যেতে হবে আত্মীয়পরশহীন দেশে

ক্ষমাহীন কর্তব্যের ডাকে।

পিছে পড়ে থাকে

এবারের মতো

ত্যাগযোগ্য গৃহসজ্জা যত।

জরাগ্রস্ত তক্তপোশ কালিমাখা-শতরঞ্চ-পাতা;

আরামকেদারা ভাঙা-হাতা;

পাশের শোবার ঘরে

হেলে-পড়া টিপয়ের 'পরে

পুরোনো আয়না দাগ-ধরা;

পোকা কাটা হিসাবের খাতা-ভরা

কাঠের সিন্দুক এক ধারে;

দেয়ালে-ঠেসান-দেওয়া সারে সারে

বহু বৎসরের পাঁজি;

কুলুঙ্গিতে অনাদৃত পূজার ফুলের জীর্ণ সাজি।

প্রদীপের স্তিমিত শিখায়

দেখা যায়,

ছায়াতে জড়িত তারা

স্তম্ভিত রয়েছে অর্থহারা।

ট্যাক্সি এল দ্বারে, দিল সাড়া

হুংকারপরুষরবে। নিদ্রায় গম্ভীর পাড়া

রহে উদাসীন।

প্রহরীশালায় দূরে বাজে সাড়ে-তিন।

শূন্যপানে চক্ষু মেলি

দীর্ঘশ্বাস ফেলি

দূরযাত্রী নাম নিল দেবতার,

তালা দিয়ে রুধিল দুয়ার।

টেনে নিয়ে অনিচ্ছুক দেহটিরে

দাঁড়ালো বাহিরে।

ঊর্ধ্বে কালো আকাশের ফাঁকা

ঝাঁট দিয়ে চলে গেল বাদুড়ের পাখা।

যেন সে নির্মম

অনিশ্চিত-পানে-ধাওয়া অদৃষ্টের প্রেতচ্ছায়াসম।

বৃদ্ধবট মন্দিরের ধারে,

অজগর-অন্ধকার গিলিয়াছে তারে।

সদ্য-মাটি-কাটা পুকুরের

পাড়ি-ধারে বাসা বাঁধা মজুরের

খেজুরের পাতা-ছাওয়া--ক্ষীণ আলো করে মিট্‌মিট্‌,

পাশে ভেঙে-পড়া পাঁজা। তলায় ছড়ানো তার ইঁট।

রজনীর মসীলিপ্তিমাঝে

লুপ্তরেখা সংসারের ছবি-- ধান-কাটা কাজে

সারাবেলা চাষীর ব্যস্ততা;

গলা-ধরাধরি কথা

মেয়েদের; ছুটি-পাওয়া

ছেলেদের ধেয়ে যাওয়া

হৈ হৈ রবে; হাটবারে ভোরবেলা

বস্তা-বহা গোরুটাকে তাড়া দিয়ে ঠেলা;

আঁকড়িয়া মহিষের গলা

ও পারে মাঠের পানে রাখাল ছেলের ভেসে চলা।

নিত্যজানা সংসারের প্রাণলীলা না উঠিতে ফুটে

যাত্রী লয়ে অন্ধকারে গাড়ি যায় ছুটে।

যেতে যেতে পথপাশে

পানাপুকুরের গন্ধ আসে,

সেই গন্ধে পায় মন

বহুদিনরজনীর সকরুণ স্নিগ্ধ আলিঙ্গন।

আঁকাবাঁকা গলি

রেলের স্টেশনপথে গেছে চলি;

দুই পাশে বাসা সারি সারি;

নরনারী

যে যাহার ঘরে

রহিল আরামশয্যা 'পরে।

নিবিড়-আঁধার-ঢালা আমবাগানের ফাঁকে

অসীমের টিকা দিয়া বরণ করিয়া স্তব্ধতাকে

শুকতারা দিল দেখা।

পথিক চলিল একা

অচেতন অসংখ্যের মাঝে।

সাথে সাথে জনশূন্য পথ দিয়ে বাজে

রথের চাকার শব্দ হদয়বিহীন ব্যস্ত সুরে

দূর হতে দূরে।