দক্ষিণায়নের সূর্যোদয় আড়াল ক'রে

সকালে বসি চাতালে।

অনুকূল অবকাশ;

তখনো নিরেট হয়ে ওঠে নি কাজের দাবি,

ঝুঁকে পড়ে নি লোকের ভিড়

পায়ে পায়ে সময় দলিত করে দিয়ে।

লিখতে বসি,

কাটা খেজুরের গুঁড়ির মতো

ছুটির সকাল কলমের ডগায় চুঁইয়ে দেয় কিছু রস।

আমাদের ময়ূর এসে পুচ্ছ নামিয়ে বসে

পাশের রেলিংটির উপর।

আমার এই আশ্রয় তার কাছে নিরাপদ,

এখানে আসে না তার বেদরদী শাসনকর্তা বাঁধন হাতে।

বাইরে ডালে ডালে কাঁচা আম পড়েছে ঝুলে,

নেবু ধরেছে নেবুর গাছে,

একটা একলা কুড়চিগাছ

আপনি আশ্চর্য আপন ফুলের বাড়াবাড়িতে।

প্রাণের নিরর্থক চাঞ্চল্যে

ময়ূরটি ঘাড় বাঁকায় এদিকে ওদিকে।

তার উদাসীন দৃষ্টি

কিছুমাত্র খেয়াল করে না আমার খাতা-লেখায়;

করত, যদি অক্ষরগুলো হত পোকা;

তা হলে নগণ্য মনে করত না কবিকে।

হাসি পেল ওর ওই গম্ভীর উপেক্ষায়,

ওরই দৃষ্টি দিয়ে দেখলুম আমার এই রচনা।

দেখলুম, ময়ূরের চোখের ঔদাসীন্য

সমস্ত নীল আকাশে,

কাঁচা-আম-ঝোলা গাছের পাতায় পাতায়,

তেঁতুলগাছের গুঞ্জনমুখর মৌচাকে।

ভাবলুম, মাহেন্দজারোতে

এইরকম চৈত্রশেষের অকেজো সকালে

কবি লিখেছিল কবিতা,

বিশ্বপ্রকৃতি তার কোনোই হিসাব রাখে নি।

কিন্তু, ময়ূর আজও আছে প্রাণের দেনাপাওনায়,

কাঁচা আম ঝুলে পড়েছে ডালে।

নীল আকাশ থেকে শুরু করে সবুজ পৃথিবী পর্যন্ত

কোথাও ওদের দাম যাবে না কমে।

আর, মাহেন্দজারোর কবিকে গ্রাহ্যই করলে না।

পথের ধারের তৃণ, আঁধার রাত্রের জোনাকি।

নিরবধি কাল আর বিপুলা পৃথিবীতে

মেলে দিলাম চেতনাকে,

টেনে নিলেম প্রকৃতির ধ্যান থেকে বৃহৎ বৈরাগ্য

আপন মনে;

খাতার অক্ষরগুলোকে দেখলুম

মহাকালের দেয়ালিতে

পোকার ঝাঁকের মতো।

ভাবলুম, আজ যদি ছিঁড়ে ফেলি পাতাগুলো

তা হলে পর্শুদিনের অস্ত্যসৎকার এগিয়ে রাখব মাত্র।

এমন সময় আওয়াজ এল কানে,

"দাদামশায়, কিছু লিখেছ না কি।"

ওই এসেছে--ময়ূর না,

ঘরে যার নাম সুনয়নী,

আমি যাকে ডাকি শুনায়নী ব'লে।

ওকে আমার কবিতা শোনাবার দাবি সকলের আগে।

আমি বললেম, "সুরসিকে, খুশি হবে না,

এ গদ্যকাব্য।"

কপালে ভ্রূকুঞ্চনের ঢেউ খেলিয়ে

বললে, "আচ্ছা, তাই সই।"

সঙ্গে একটু স্তুতিবাক্য দিলে মিলিয়ে;

বললে, "তোমার কণ্ঠস্বরে,

গদ্যে রঙ ধরে পদ্যের।"

ব'লে গলা ধরলে জড়িয়ে।

আমি বললেম, "কবিত্বের রঙ লাগিয়ে নিচ্ছ

কবিকণ্ঠ থেকে তোমার বাহুতে?"

সে বললে, "অকবির মতো হল তোমার কথাটা;

কবিত্বের স্পর্শ লাগিয়ে দিলেম তোমারই কণ্ঠে,

হয়তো জাগিয়ে দিলেম গান।"

শুনলুম নীরবে, খুশি হলুম নিরুত্তরে।

মনে-মনে বললুম, প্রকৃতির ঔদাসীন্য অচল রয়েছে

অসংখ্য বর্ষকালের চূড়ায়,

তারই উপরে একবারমাত্র পা ফেলে চলে যাবে

আমার শুনায়নী,

ভোরবেলার শুকতারা।

সেই ক্ষণিকের কাছে হার মানবে বিরাটকালের বৈরাগ্য।

মাহেন্দজারোর কবি, তোমার সন্ধ্যাতারা

অস্তাচল পেরিয়ে

আজ উঠেছে আমার জীবনের

উদয়াচলশিখরে।