বাসস্থানপরিবর্তন-উপলক্ষে

বন্ধুবর,

দক্ষিণে বেঁধেছি নীড়, চুকেছে লোকের ভিড়;

বকুনির বিড় বিড় গেছে থেমে-থুমে।

আপনারে করে জড়ো কোণে বসে আছি দড়ো,

আর সাধ নেই বড়ো আকাশকুসুমে।

সুখ নেই, আছে শান্তি, ঘুচেছে মনের ভ্রান্তি,

"বিমুখা বান্ধবা যান্তি' বুঝিয়াছি সার।

কাছে থেকে কাটে সুখে গল্প ও গুড়ুক ফুঁকে,

গেলে দক্ষিণের মুখে দেখা নেই আর।

কাজ কী এ মিছে নাট, তুলেছি দোকান হাট,

গোলমাল চণ্ডীপাঠ আছি ভাই ভুলি।

তবু কেন খিটিমিটি, মাঝে মাঝে কড়া চিঠি,

থেকে থেকে দু-চারিটি চোখা চোখা বুলি।

"পেটে খেলে পিঠে সয়' এই তো প্রবাদে কয়,

ভুলে যদি দেখা হয় তবু সয়ে থাকি।

হাত করে নিশপিশ, মাঝে রেখে পোস্টাপিস

ছাড় শুধু দশ-বিশ শব্দভেদী ফাঁকি।

বিষম উৎপাত এ কী! হায় নারদের ঢেঁকি!

শেষকালে এ যে দেখি ঝগড়ার মতো।

মেলা কথা হল জমা, এইখানে দিই "কমা',

আমার স্বভাব ক্ষমা, নির্বিবাদ ব্রত।

কেদারার 'পরে চাপি ভাবি শুধু ফিলজাফি,

নিতান্তই চুপিচাপি মাটির মানুষ।

লেখা তো লিখেছি ঢের, এখন পেয়েছি টের

সে কেবল কাগজের রঙিন ফানুস।

আঁধারের কূলে কূলে ক্ষীণশিখা মরে দুলে,

পথিকেরা মুখ তুলে চেয়ে দেখে তাই।

নকল নক্ষত্র হায় ধ্রুবতারা পানে ধায়,

ফিরে আসে এ ধরায় একরত্তি ছাই।

সবারে সাজে না ভালো, হৃদয়ে স্বর্গের আলো

আছে যার সেই জ্বালো আকাশের ভালে--

মাটির প্রদীপ যার নিবে-নিবে বারবার

সে দীপ জ্বলুক তার গৃহের আড়ালে।

যারা আছে কাছাকাছি তাহাদের নিয়ে আছি--

শুধু ভালোবেসে বাঁচি, বাঁচি যত কাল।

আশা কভু নাহি মেটে ভূতের বেগার খেটে,

কাগজে আঁচড় কেটে সকাল বিকাল।

কিছু নাহি করি দাওয়া, ছাতে বসে খাই হাওয়া

যতটুকু পড়ে-পাওয়া ততটুকু ভালো--

যারা মোরে ভালোবাসে ঘুরে ফিরে কাছে আসে,

হাসিখুশি আশেপাশে নয়নের আলো।

বাহবা যে জন চায় বসে থাক্‌ চৌমাথায়,

নাচুক তৃণের প্রায় পথিকের স্রোতে--

পরের মুখের বুলি ভরুক ভিক্ষার ঝুলি,

নাই চাল নাই চুলি ধূলির পর্বতে।

বেড়ে যায় দীর্ঘ ছন্দ, লেখনী না হয় বন্ধ,

বক্তৃতার নামগন্ধ পেলে রক্ষে নেই।

ফেনা ঢোকে নাকে চোখে, প্রবল মিলের ঝোঁকে

ভেসে যাই একরোখে বুঝি দক্ষিণেই।

বাহিরেতে চেয়ে দেখি দেবতাদুর্যোগ এ কী,

বসে বসে লিখিতে কি আর সরে মন।

আর্দ্র বায়ু বহে বেগে, গাছপালা ওঠে জেগে,

ঘনঘোর স্নিগ্ধ মেঘে আঁধার গগন।

বেলা যায়, বৃষ্টি বাড়ে, বসি আলিসার আড়ে

ভিজে কাক ডাক ছাড়ে মনের অসুখে।

রাজপথ জনহীন, শুধু পান্থ দুই তিন

ছাতার ভিতরে লীন ধায় গৃহমুখে।

বৃষ্টি-ঘেরা চারি ধার, ঘনশ্যাম অন্ধকার,

ঝুপ-ঝুপ শব্দ আর ঝর-ঝর পাতা।

থেকে থেকে ক্ষণে ক্ষণে গুরু গুরু গরজনে

মেঘদূত পড়ে মনে আষাঢ়ের গাথা।

পড়েমনে বরিষার বৃন্দাবন অভিসার,।

একাকিনী রাধিকার চকিত চরণ--

শ্যামল তমালতল, নীল যমুনার জল,

আর দুটি ছলছল নলিননয়ন।

এ ভরা বাদর দিনে কে বাঁচিবে শ্যাম বিনে,

কাননের পথ চিনে মন যেতে চায়।

বিজন যমুনাকূলে বিকশিত নীপমূলে

কাঁদিয়া পরান বুলে বিরহব্যাথায়।

দোহাই কল্পনা তোর, ছিন্ন কর্‌ মায়াডোর,

কবিতায় আর মোর নাই কোনো দাবি।

বিরহ, বকুল, আর বৃন্দাবন স্তূপকার

সেগুলো চাপাই কার স্কন্ধে তাই ভাবি।

এখন ঘরের ছেলে বাঁচি ঘরে ফিরে গেলে,

দু-দণ্ড সময় পেলে নাবার খাবার

কলম হাঁকিয়ে ফেরা সকল রোগের সেরা,

তাই কবি-মানুষেরা অস্থিচর্মসার।

কলমের গোলামিটা আর নাহি লাগে মিঠা,

তার চেয়ে দুধ-ঘি'টা বহু গুণে শ্রেয়।

সাঙ্গ করি এইখানে-- শেষে বলি কানে কানে,

পুরানো বন্ধুর পানে মুখ তুলে চেয়ো।