ধরাতলে

চঞ্চলতা সব-আগে নেমেছিল জলে।

সবার প্রথম ধ্বনি উঠেছিল জেগে

তারি স্রোতোবেগে।

তরঙ্গিত গতিমত্ত সেই জল

কলোল্লোলে উদ্‌বেল উচ্ছল

শৃঙ্খলিত ছিল স্তব্ধ পুকুরে আমার,

নৃত্যহীন ঔদাসীন্যে অর্থহীন শূন্যদৃষ্টি তার।

গান নাই, শব্দের তরণী হোথা ডোবা,

প্রাণ হোথা বোবা।

জীবনের রঙ্গমঞ্চে ওখানে রয়েছে পর্দা টানা,

ওইখানে কালো বরনের মানা।

ঘটনার স্রোত নাহি বয়,

নিস্তব্ধ সময়।

হোথা হতে তাই মনে দিত সাড়া

সময়ের বন্ধ-ছাড়া

ইতিহাস-পলাতক কাহিনীর কত

সৃষ্টিছাড়া সৃষ্টি নানামতো।

উপরের তলা থেকে

চেয়ে দেখে

না-দেখা গভীরে ওর মায়াপুরী এঁকেছিনু মনে।

নাগকন্যা মানিকদর্পণে

সেথায় গাঁথিছে বেণী,

কুঞ্চিত লহরিকার শ্রেণী

ভেসে যায় বেঁকে বেঁকে

যখন বিকেলে হাওয়া জাগিয়া উঠিত থেকে থেকে।

তীরে যত গাছপালা পশুপাখি

তারা আছে অন্যলোকে, এ শুধু একাকী।

তাই সব

যত কিছু অসম্ভব

কল্পনার মিটাইত সাধ,

কোথাও ছিল না তার প্রতিবাদ।

তার পরে মনে হল একদিন,

সাঁতারিতে পেল যারা পৃথিবীতে তারাই স্বাধীন,

বন্দী তারা যারা পায় নাই।

এ আঘাত প্রাণে নিয়ে চলিলাম তাই

ভূমির নিষেধগণ্ডি হতে পার।

অনাত্মীয় শত্রুতার

সংশয় কাটিল ধীরে ধীরে,

জলে আর তীরে

আমারে মাঝেতে নিয়ে হল বোঝাপড়া।

আঁকড়িয়া সাঁতারের ঘড়া

অপরিচয়ের বাধা উত্তীর্ণ হয়েছি দিনে দিনে,

অচেনার প্রান্তসীমা লয়েছিনু চিনে।

পুলকিত সাবধানে

নামিতাম স্নানে,

গোপন তরল কোন্‌ অদৃশ্যের স্পর্শ সর্ব গায়ে

ধরিত জড়ায়ে।

হর্ষ-সাথে মিলি ভয়

দেহময়

রহস্য ফেলিত ব্যাপ্ত করি।

পূর্বতীরে বৃদ্ধ বট প্রাচীন প্রহরী

গ্রন্থিল শিকড়গুলো কোথায় পাঠাত নিরালোকে

যেন পাতালের নাগলোকে।

এক দিকে দূর আকাশের সাথে

দিনে রাতে

চলে তার আলোকছায়ার আলাপন,

অন্য দিকে দূর নিঃশব্দের তলে নিমজ্জন

কিসের সন্ধানে

অবিচ্ছিন্ন প্রচ্ছন্নের পানে।

সেই পুকুরের

ছিনু আমি দোসর দূরের

বাতায়নে বসি নিরালায়,

বন্দী মোরা উভয়েই জগতের ভিন্ন কিনারায়;

তার পরে দেখিলাম, এ পুকুর এও বাতায়ন--

এক দিকে সীমা বাঁধা, অন্য দিকে মুক্ত সারাক্ষণ।

করিয়াছি পারাপার

যত শত বার

ততই এ তটে-বাঁধা জলে

গভীরের বক্ষতলে

লভিয়াছি প্রতি ক্ষণে বাধা-ঠেলা স্বাধীনের জয়,

গেছে চলি ভয়।