ধীরে ধীরে বিস্তারিছে ঘেরি চারিধার

শ্রান্তি আর শান্তি আর সন্ধ্যা-অন্ধকার,

মায়ের অঞ্চলসম। দাঁড়ায়ে একাকী

মেলিয়া পশ্চিমপানে অনিমেষ আঁখি

স্তব্ধ চেয়ে আছি। আপনারে মগ্ন করি

অতলের তলে, ধীরে লইতেছি ভরি

জীবনের মাঝে-- আজিকার এই ছবি,

জনশূন্য নদীতীর, অস্তমান রবি,

ম্লান মূর্ছাতুর আলো-- রোদন-অরুণ,

ক্লান্ত নয়নের যেন দৃষ্টি সকরুণ

স্থির বাক্যহীন-- এই গভীর বিষাদ,

জলে স্থলে চরাচরে শ্রান্তি অবসাদ।

সহসা উঠিল গাহি কোন্‌খান হতে

বন-অন্ধকারঘন কোন্‌ গ্রামপথে

যেতে যেতে গৃহমুখে বালক-পথিক।

উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর নিশ্চিন্ত নির্ভীক

কাঁপিছে সপ্তম সুরে, তীব্র উচ্চতান

সন্ধ্যারে কাটিয়া যেন করিবে দুখান।

দেখিতে না পাই তারে। ওই যে সম্মুখে

প্রান্তরের সর্বপ্রান্তে, দক্ষিণের মুখে,

আখের খেতের পারে, কদলী সুপারি

নিবিড় বাঁশের বন, মাঝখানে তারি

বিশ্রাম করিছে গ্রাম, হোথা আঁখি ধায়।

হোথা কোন্‌ গৃহপানে গেয়ে চলে যায়

কোন্‌ রাখালের ছেলে, নাহি ভাবে কিছু,

নাহি চায় শূন্যপানে, নাহি আগুপিছু।

দেখে শুনে মনে পড়ে সেই সন্ধ্যাবেলা

শৈশবের। কত গল্প, কত বাল্যখেলা,

এক বিছানায় শুয়ে মোরা সঙ্গী তিন;

সে কি আজিকার কথা, হল কত দিন।

এখনো কি বৃদ্ধ হয়ে যায় নি সংসার।

ভোলে নাই খেলাধুলা, নয়নে তাহার

আসে নাই নিদ্রাবেশ শান্ত সুশীতল,

বাল্যের খেলানাগুলি করিয়া বদল

পায় নি কঠিন জ্ঞান? দাঁড়ায়ে হেথায়

নির্জন মাঠের মাঝে, নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়,

শুনিয়া কাহার গান পড়ি গেল মনে--

কত শত নদীতীরে, কত আম্রবনে,

কাংস্যঘণ্টা-মুখরিত মন্দিরের ধারে,

কত শস্যক্ষেত্রপ্রান্তে, পুকুরের পাড়ে

গৃহে গৃহে জাগিতেছে নব হাসিমুখ,

নবীন হৃদয়ভরা নব নব সুখ,

কত অসম্ভব কথা, অপূর্ব কল্পনা,

কত অমূলক আশা, অশেষ কামনা,

অনন্ত বিশ্বাস। দাঁড়াইয়া অন্ধকারে

দেখিনু নক্ষত্রালোকে, অসীম সংসারে

রয়েছে পৃথিবী ভরি বালিকা বালক,

সন্ধ্যাশয্যা, মার মুখ, দীপের আলোক।