পুরুষের পক্ষে সব তন্ত্রমন্ত্র মিছে,

মনু-পরাশরদের সাধ্য নাই টানে তারে পিছে।

বুদ্ধি মেনে চলা তার রোগ;

খাওয়া ছোঁওয়া সব-তাতে তর্ক করে, বাধে গোলযোগ।

মেয়েরা বাঁচাবে দেশ, দেশ যবে ছুটে যায় আগে।

হাই তুলে দুর্গা ব'লে যেন তারা শেষরাতে জাগে;

খিড়কির ডোবাটাতে সোজা

ব'হে যেন নিয়ে আসে যত এঁটো বাসনের বোঝা;

মাজা-ঘষা শেষ করে আঙিনায় ছোটে--

ধড়্‌ফড়ে জ্যান্ত মাছ কোটে

দুই হাতে ল্যাজামুড়ো জাপটিয়ে ধ'রে

সুনিপুণ কবজির জোরে,

ছাই পেতে বঁটির উপরে চেপে ব'সে,

কোমরে আঁচল বেঁধে ক'ষে।

কুটিকুটি বানায় ইঁচোড়;

চাকা চাকা করে থোড়,

আঙুলে জড়ায় তার সুতো;

মোচাগুলো ঘস্‌ ঘস্‌ কেটে চলে দ্রুত;

চালতারে

বিশ্লেষণ করে খরধারে।

বেগুন পটোল আলু খণ্ড খণ্ড হয় সে অগুন্তি।

তার পরে হাতা বেড়ি খুন্তি;

তিন-চার দফা রান্না সে

নানা ফরমাশে--

আপিসের, ইস্কুলের, পেট-রোগা রুগির কোনোটা,

সিদ্ধ চাল, সরু চাল, ঢেঁকিছাঁটা, কোনোটা বা মোটা।

যবে পাবে ছুটি

বেলা হবে আড়াইটা। বিড়ালকে দিয়ে কাঁটাকুটি

পান-দোক্তা মুখে পুরে দিতে যাবে ঘুম;

ছেলেটা চেঁচায় যদি পিঠে কিল দেবে ধুমাধুম,

বলবে "বজ্জাত ভারি"।

তার পরে রাত্রে হবে রুটি আর বাসি তরকারি।

জনার্দন ঠাকুরের

পানাপুকুরের

পাড়ের কাছটা ঢাকা কলমির শাকে।

গা ধুয়ে তাহারই এক ফাঁকে,

ঘড়া কাঁখে, গায়েতে জড়ায়ে ভিজে শাড়ি

ঘন ঘন হাত নাড়ি

খস্‌খস্‌-শব্দ-করা পাতায় বিছানো বাঁশবনে

রাম নাম জপি মনে মনে

ঘরে ফিরে যায় দ্রুতপায়ে

গোধূলির ছম্‌ছমে অন্ধকারছায়ে।

সন্ধেবেলা বিধবা ননদি বসে ছাতে,

জপমালা ঘোরে হাতে।

বউ তার চুলের জটায়

চিরুনি-আঁচড় দিয়ে কানে কানে কলঙ্ক রটায়

পাড়াপ্রতিবেশিনীর-- কোনো সূত্রে শুনতে সে পেয়ে

হন্তদন্ত আসে ধেয়ে

ও-পাড়ার বোসগিন্নি; চোখা চোখা বচন বানায়ে

স্বামীপুত্র-খাদনের আশা তার যায় সে জানায়ে।

কাপড়-জড়ানো পুঁথি কাঁখে

তিলক কাটিয়া নাকে

উপস্থিত আচার্যি মশায়--

গিন্নির মধ্যমপুত্র শনির দশায়--

আটক পড়েছে তার বিয়ে;

তাহারই ব্যবস্থা নিয়ে

স্বস্ত্যয়নের ফর্দ মস্ত,

কর্তারে লুকিয়ে তারই খরচের হল বন্দোবস্ত।

এমনি কাটিয়ে যায় সনাতনী দিনগুলি যত

চাটুজ্যেমশা'র অনুমত--

কলহে ও নামজপে, ভবিষ্যৎ জামাতার খোঁজে,

নেশাখোর ব্রাহ্মণের ভোজে।

মেয়েরাও বই যদি নিতান্তই পড়ে

মন যেন একটু না নড়ে।

নূতন বই কি চাই। নূতন পঞ্জিকাখানা কিনে

মাথায় ঠেকায়ে তারে প্রণাম করুক শুভদিনে।

আর আছে পাঁচালির ছড়া,

বুদ্ধিতে জড়াবে জোরে ন্যাশন্যাল কাল্‌চারের দড়া।

দুর্গতি দিয়েছে দেখা; বঙ্গনারী ধরেছে শেমিজ,

বি. এ. এম. এ. পাস ক'রে ছড়াইছে বীজ

যুক্তি-মানা ঘোর ম্লেচ্ছতার।

ধর্মকর্ম হল ছারখার।

শীতলামায়ীরে করে হেলা;

বসন্তের টিকা নেয়; "গ্রহণের বেলা

গঙ্গাস্নানে পাপ নাশে'

শুনিয়া মূর্খের মতো হাসে।

তবু আজও রক্ষা আছে, পবিত্র এ দেশে

অসংখ্য জন্মেছে মেয়ে পুরুষের বেশে।

মন্দির রাঙায় তারা জীবরক্তপাতে,

সে-রক্তের ফোঁটা দেয় সন্তানের মাথে।

কিন্তু, যবে ছাড়ে নাড়ী

ভিড় ক'রে আসে দ্বারে ডাক্তারের গাড়ি।

অঞ্জলি ভরিয়া পূজা নেন সরস্বতী,

পরীক্ষা দেবার বেলা নোটবুক ছাড়া নেই গতি।

পুরুষের বিদ্যে নিয়ে কলেজে চলেছে যত নারী

এই ফল তারই।

মেয়েদের বুদ্ধি নিয়ে পুরুষ যখন ঠাণ্ডা হবে,

দেশখানা রক্ষা পাবে তবে।

বুঝি নে একটা কথা, ভয়ের তাড়ায়

দিন দেখে তবে যেথা ঘরের বাহিরে পা বাড়ায়

সেই দেশে দেবতার কুপ্রথা অদ্ভুত,

সব চেয়ে অনাচারী সেথা যমদূত।

ভালো লগ্নে বাধা নেই, পাড়ায় পাড়ায় দেয় ডঙ্কা।

সব দেশ হতে সেথা বেড়ে চলে মরণের সংখ্যা।

বেস্পতিবারের বারবেলা

এ কাব্য হয়েছে লেখা, সামলাতে পারব কি ঠেলা।