পশ্চিমে বাগান বন চষা-খেত

মিলে গেছে দূর বনান্তে বেগনি বাষ্পরেখায়;

মাঝে আম জাম তাল তেঁতুলে ঢাকা

সাঁওতালপাড়া;

পাশ দিয়ে ছায়াহীন দীর্ঘ পথ গেছে বেঁকে

রাঙা পাড় যেন সবুজ শাড়ির প্রান্তে কুটিল রেখায়।

হঠাৎ উঠেছে এক-একটা যূথভ্রষ্ট তালগাছ,

দিশাহারা অনির্দিষ্টকে যেন দিক দেখাবার ব্যাকুলতা।

পৃথিবীর একটানা সবুজ উত্তরীয়

তারি এক ধারে ছেদ পড়েছে উত্তর দিকে,

মাটি গেছে ক্ষ'য়ে,

দেখা দিয়েছে

উর্মিল লাল কাঁকরের নিস্তব্ধ তোলপাড়--

মাঝে মাঝে মরচে-ধরা কালো মাটি

মহিষাসুরের মুণ্ড যেন।

পৃথিবী আপনার একটি কোণের প্রাঙ্গণে

বর্ষাধারার আঘাতে বানিয়েছে

ছোটো ছোটো অখ্যাত খেলার পাহাড়,

বয়ে চলেছে তার তলায় তলায় নামহীন খেলার নদী।

শরৎকালে পশ্চিম-আকাশে

সূর্যাস্তের ক্ষণিক সমারোহে

রঙের সঙ্গে রঙের ঠেলাঠেলি--

তখন পৃথিবীর এই ধূসর ছেলেমানুষির উপরে

দেখেছি সেই মহিমা

যা একদিন পড়েছে আমার চোখে

দুর্লভ দিনাবসানে

রোহিত সমুদ্রের তীরে তীরে

জনশূন্য তরুহীন পর্বতের রক্তবর্ণ শিখরশ্রেণীতে,

রুষ্টরুদ্রের প্রলয়ভ্রূকুঞ্চনের মতো।

এই পথে ধেয়ে এসেছে কালবৈশাখীর ঝড়,

গেরুয়া পতাকা উড়িয়ে

ঘোড়সওয়ার বর্গি- সৈন্যের মতো--

কাঁপিয়ে দিয়েছে শাল-সেগুনকে,

নুইয়ে দিয়েছে ঝাউয়ের মাথা,

হায়-হায় রব তুলেছে বাঁশের বনে,

কলাবাগানে করেছে দুঃশাসনের দৌরাত্ম্য।

ক্রন্দিত আকাশের নীচে ওই ধূসর বন্ধুর

কাঁকরের স্তূপগুলো দেখে মনে হয়েছে

লাল সমুদ্রে তুফান উঠল,

ছিটকে পড়ছে তার শীকরবিন্দু।

এসেছিলেম বালককালে।

ওখানে গুহাগহ্বরে

ঝির্‌ ঝির্‌ ঝর্নার ধারায়

রচনা করেছি মন-গড়া রহস্যকথা,

খেলেছি নুড়ি সাজিয়ে

নির্জন দুপুর বেলায় আপন-মনে একলা।

তার পরে অনেক দিন হল,

পাথরের উপর নির্ঝরের মতো

আমার উপর দিয়ে

বয়ে গেল অনেক বৎসর।

রচনা করতে বসেছি একটা কাজের রূপ

ওই আকাশের তলায় ভাঙামাটির ধারে,

ছেলেবেলায় যেমন রচনা করেছি

নুড়ির দুর্গ!

এই শালবন, এই একলা-মেজাজের তালগাছ,

ওই সবুজ মাঠের সঙ্গে রাঙামাটির মিতালি

এর পানে অনেক দিন যাদের সঙ্গে দৃষ্টি মিলিয়েছি,

যারা মন মিলিয়েছিল

এখানকার বাদল-দিনে আর আমার বাদল-গানে,

তারা কেউ আছে কেউ গেল চলে।

আমারও যখন শেষ হবে দিনের কাজ,

নিশীথরাত্রের তারা ডাক দেবে

আকাশের ও পার থেকে--

তার পরে?

তার পরে রইবে উত্তর দিকে

ওই বুক-ফাটা ধরণীর রক্তিমা,

দক্ষিণ দিকে চাষের খেত,

পুব দিকের মাঠে চরবে গোরু।

রাঙামাটির রাস্তা বেয়ে

গ্রামের লোক যাবে হাট করতে।

পশ্চিমের আকাশপ্রান্তে

আঁকা থাকবে একটি নীলাঞ্জনরেখা।