বাবা এসে শুধালেন,

"কী করছিস সুনি,

কাপড় কেন তুলিস বাক্সে, যাবি কোথায়?'

সুনৃতার ঘর তিনতলায়।

দক্ষিণ দিকে দুই জানলা,

সামনে পালঙ্ক,

বিছানা লক্ষ্ণৌ-ছিটে ঢাকা।

অন্য দেয়ালে লেখবার টেবিল,

তার কোণে মায়ের ফোটোগ্রাফ--

তিনি গেছেন মারা।

বাবার ছবি দেয়ালে,

ফ্রেমে জড়ানো ফুলের মালা।

মেঝেতে লাল শতরঞ্চে

শাড়ি শেমিজ ব্লাউজ

মোজা রুমাল ছড়াছড়ি।

কুকুরটা কাছ ঘেঁষে লেজ নাড়ছে,

ঠেলা দিচ্ছে কোলে থাবা তুলে--

ভেবে পাচ্ছে না কিসের আয়োজন,

ভয় হচ্ছে পাছে ওকে ফেলে রেখে আবার যায় কোথাও।

ছোটো বোন শমিতা বসে আছে হাঁটু উঁচু করে,

বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে।

চুল বাঁধা হয় নি,

চোখ দুটি রাঙা কান্নার অবসানে।

চুপ করে রইল সুনৃতা,

মুখ নিচু করে সে কাপড় গোছায়--

হাত কাঁপে।

বাবা আবার বললেন,

"সুনি, কোথাও যাবি নাকি।'

সুনৃতা শক্ত করে বললে, "তুমি তো বলেইছ

এ বাড়িতে হতে পারবে না আমার বিয়ে,

আমি যাব অনুদের বাসায়।'

শমিতা বললে, "ছি ছি, দিদি, কী বলছ।'

বাবা বললেন, "ওরা যে মানে না আমাদের মত।'

"তবু ওদের মতই যে আমাকে মানতে হবে চিরদিন--'

এই বলে সুনি সেফটিপিন ভরে রাখলে লেফাফায়।

দৃঢ় ওর কণ্ঠস্বর, কঠিন ওর মুখের ভাব,

সংকল্প অবিচলিত।

বাবা বললেন, "অনিলের বাপ জাত মানে,

সে কি রাজি হবে।'

সগর্বে বলে উঠল সুনৃতা,

"চেন না তুমি অনিলবাবুকে,

তাঁর জোর আছে পৌরুষের, তাঁর মত তাঁর নিজের।'

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বাবা চলে গেলেন ঘর থেকে,

শমিতা উঠে তাঁকে জড়িয়ে ধরলে--

বেরিয়ে গেল তাঁর সঙ্গে।

বাজল দুপুরের ঘণ্টা।

সকাল থেকে খাওয়া নেই সুনৃতার।

শমিতা একবার এসেছিল ডাকতে--

ও বললে, খাবে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে।

মা-মরা মেয়ে, বাপের আদুরে,

মিনতি করতে আসছিলেন তিনি;

শমিতা পথ আগলিয়ে বললে,

"কক্‌খনো যেতে পারবে না বাবা,

ও না খায় তো নেই খেল।'

জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে

দেখলে সুনৃতা রাস্তার দিকে,

এসেছে অনুদের গাড়ি।

তাড়াতাড়ি চুলটা আঁচড়িয়ে

ব্রোচটা লাগাচ্ছে যখন কাঁধে,

শমি এসে বললে, "এই নাও তাদের চিঠি।'

ব'লে ফেলে দিলে ছুঁড়ে ওর কোলে।

সুনৃতা পড়লে চিঠিখানা,

মুখ হয়ে গেল ফ্যাকাশে,

বসে পড়ল তোরঙ্গের উপর।

চিঠিতে আছে--

"বাবার মত করতে পারব নিশ্চিত ছিল মনে,

হল না কিছুতেই,

কাজেই--'

বাজল একটা।

সুনি চুপ করে ব'সে, চোখে জল নেই।

রামচরিত বললে এসে,

"মোটর দাঁড়িয়ে অনেক ক্ষণ।'

সুনি বললে, "যেতে বলে দে।'

কুকুরটা কাছে এসে বসে রইল চুপ করে।

বাবা বুঝলেন,

প্রশ্ন করলেন না--

বললেন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে,

"চল্‌ সুনি, হোসেঙ্গাবাদে তোর মামার ওখানে।'

কাল বিয়ের দিন।

অনিল জিদ করেছিল হবে না বিয়ে।

মা ব্যথিত হয়ে বলেছিল, "থাক্‌-না।'

বাপ বললে, "পাগল নাকি।'

ইলেক্‌ট্রিক বাতির মালা খাটানো হচ্ছে বাড়িতে,

সমস্ত দিন বাজছে সানাই।

হূহু করে উঠছে অনিলের মনটা।

তখন সন্ধ্যা সাতটা।

সুনিদের বউবাজারের বাড়ির এক তলায়।

ডাবাহুঁকো বাঁ হাতে ধরে তামাক খাচ্ছে

কৈলেস সরকার,

আর তালপাতার পাখায় বাতাস চলছে ডান হাতে;

বেহারাকে ডেকেছে পা টিপে দেবে।

কালিমাখা ময়লা জাজিমে কাগজপত্র রাশ করা;

জ্বলছে একটা কেরোসিন লণ্ঠন।

হঠাৎ অনিল এসে উপস্থিত।

কৈলেস শশব্যস্ত উঠে দাঁড়ালো

শিথিল কাছাকোঁচা সামলিয়ে।

অনিল বললে,

"পার্বণীটা ভুলেছিলেম গোলেমালে,

তাই এসেছি দিতে।'

তার পরে বাধো-বাধো গলায় বললে,

"অমনি দেখে যাব তোমাদের সুনিদিদির ঘরটা।'

গেল ঘরে।

খাটের উপর রইল বসে মাথায় হাত দিয়ে।

কিসের একটা অস্পষ্ট গন্ধ,

মূর্ছিতের নিশ্বাসের মতো।

সে গন্ধ চুলের না শুকনো ফুলের

না শূন্য ঘরে সঞ্চিত বিজড়িত স্মৃতির--

বিছানায়, চৌকিতে, পর্দায়।

সিগারেট ধরিয়ে টানল কিছুক্ষণ,

ছুঁড়ে ফেলে দিল জানলার বাইরে।

টেবিলের নীচে থেকে ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িটা

নিল কোলে তুলে।

ধক্‌ করে উঠল বুকের মধ্যে;

দেখলে ঝুড়ি-ভরা রাশি রাশি ছেঁড়া চিঠি,

ফিকে নীল রঙের কাগজে

অনিলেরই হাতে লেখা।

তার সঙ্গে টুকরো টুকরো ছেঁড়া একটা ফোটোগ্রাফ।

আর ছিল বছর চার আগেকার

দুটি ফুল, লাল ফিতেয় বাঁধা

মেডেন-হেয়ার পাতার সঙ্গে

শুকনো প্যান্‌সি আর ভায়োলেট।