বালক বয়স ছিল যখন, ছাদের কোণের ঘরে

নিঝুম দুইপহরে

দ্বারের 'পরে হেলিয়ে মাথা

মেঝে মাদুর পাতা,

একা একা কাটত রোদের বেলা--

না মেনেছি পড়ার শাসন, না করেছি খেলা।

দূর আকাশে ডেকে যেত চিল,

সিসুগাছের ডালপালা সব বাতাসে ঝিলমিল।

তপ্ত তৃষায় চঞ্চু করি ফাঁক

প্রাচীর-'পরে ক্ষণে ক্ষণে বসত এসে কাক।

চড়ুই পাখির আনাগোনা মুখর কলভাষা--

ঘরের মধ্যে কড়ির কোণে ছিল তাদের বাসা।

ফেরিওয়ালার ডাক শোনা যায় গলির ওপার থেকে--

দূরের ছাদে ঘুড়ি ওড়ায় সে কে।

কখন্‌ মাঝে-মাঝে

ঘড়িওয়ালা কোন্‌ বাড়িতে ঘণ্টাধ্বনি বাজে।

সামনে বিরাট অজানিত, সামনে দৃষ্টি-পেরিয়ে-যাওয়া দূর

বাজাত কোন্‌ ঘর-ভোলানো সুর।

কিসের পরিচয়ের লাগি

আকাশ-পাওয়া উদাসী মন সদাই ছিল জাগি।

অকারণের ভালোলাগা

অকারণের ব্যথায় মিলে গাঁথত স্বপন নাইকো গোড়া আগা।

সাথিহীনের সাথি

মনে হত দেখতে পেতেম দিগন্তে নীল আসন ছিল পাতি।

সত্তরে আজ পা দিয়েছি আয়ুশেষের কূলে

অন্তরে আজ জানলা দিলেম খুলে।

তেমনি আবার বালকদিনের মতো

চোখ মেলে মোর সুদূর-পানে বিনা কাজে প্রহর হল গত।

প্রখর তাপের কাল,

ঝরঝরিয়ে কেঁপে ওঠে শিরীষগাছের ডাল;

কুয়োর ধারে তেঁতুলতলায় ঢুকে

পাড়ার কুকুর ঘুমিয়ে পড়ে ভিজে মাটির স্নিগ্ধ পরশসুখে।

গাড়ির গোরু ক্ষণকালের মুক্তি পেয়ে ক্লান্ত আছে শুয়ে

জামের ছায়ার তৃণবিহীন ভুঁয়ে।

কাঁকর-পথের পারে

শুকনো পাতার দৈন্য জমে গন্ধরাজের সারে।

চেয়ে আছি দু-চোখ দিয়ে সব-কিছুরে ছুঁয়ে,

ভাবনা আমার সবার মাঝে থুয়ে।

বালক যেমন নগ্ন-আবরণ,

তেমনি আমার মন

ঐ কাননের সবুজ ছায়ায় এই আকাশের নীলে

বিনা বাধায় এক হয়ে যায় মিলে।

সকল জানার মাঝে

চিরকালের না-জানা কার শঙ্খধ্বনি বাজে।

এই ধরণীর সকল সীমায় সীমাহারার গোপন আনাগোনা

সেই আমারে করেছে আন্‌মনা।