বিদায় নিয়ে চলে আসবার বেলা বললেম তাকে,

"ভারতের একজন নারী বলেছিলেন একদিন--

উপকরণ চান না তিনি,

তিনি চান অমৃত

এই তো নারীর পণ,

তুমি কী বল।"

অমিয়া হাসল একটু বিরস হাসি;

বললে, " এ কি উপদেশ।"

আমি বললেম তার হাত চেপে ধরে,

"ভালোবাসাই সেই অমৃত,

উপকরণ তার কাছে তুচ্ছ,

বুঝবে একদিন।"

বিরক্ত হল অমিয়া;

বললে, " তুমি কেন নিয়ে গেলে না আমাকে মিথ্যে থেকে।

জোর নেই কেন তোমার।"

আমি বললেম, "বাধে আত্মগৌরবে।

যতদিন না ধনে হব সমান

আসব না তোমার কাছে।"

অমিয়া মাথা-ঝাঁকানি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো,

চলল ঘরের বাইরে।

আমি বললেম, "শুনে রাখো,

তোমার ভালোবাসার বদলে

দেব না তোমাকে অকিঞ্চনের অসম্মান।

এই আমার পুরুষের পণ।"

দিন যায়, রাত যায়,

মাথায় চড়ে ওঠে সোনার মদের নেশা।

সঞ্চয়ের ধাক্কা যতই বাড়ে

ততই আমাকে চলে ঠেলে।

থামতে পারি নে, থামাতে পারি নে তার তাড়না।

বিত্ত বাড়ে, খ্যাতি বাড়ে,

বুক ফুলিয়ে এগিয়ে চলে আত্মশ্লাঘা।

শেষে ডাক্তার বললে, বিশ্রাম চাই নিতান্তই,

দেহের কল অচল হয়ে এল বলে।

গেলেম দূরদেশে নির্জনে

সেখানে সমুদ্রের একটা খাড়ি এসে মিলেছে

পাহাড়তলির অরণ্যে।ভিড় জমেছে গাছে গাছে

মাছ-ধরা পাখিদের পাড়ার।

ক্ষীণ নদীটি ঝরে পড়েছে পাহাড় থেকে

পাথরের ধাপে ধাপে।

নুড়ি ডিঙিয়ে বেঁকে চলা

তার ফটিক জলের কল্‌কলানি

ধরিয়ে রেখেছে একটি মূল সুর নির্জনতার।

নিত্য-স্নান-করা সেখানকার হাওয়া

চলেছে মন্ত্র গুন্‌গুনিয়ে বনের থেকে বনে।

দল বেঁধেছে নারকেল গাছ --

কেউ খাড়া, কেউ হেলে-পড়া,

দিনরাত ওদের ঝালর-ঝোলা অস্থিরপনা।

ফিরে ফিরে আছাড় খেয়ে ফেনিয়ে উঠছে জেদালো ঢেউ

মোটা মোটা কালো পাথরে;

ডাঙায় ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে

ঝিনুক শামুক শ্যাওলা।

ক্লান্ত শরীর ব্যস্ত মনকে ফিরিয়েছে

শান্ত রক্তধারার স্নিগ্ধতায়।

কর্মের নেশার ঝাঁজ এল মরে।

এতকালের খাটুনি মনে হল যেন ফাঁকি,

প্রাণ উঠল দু হাত বাড়িয়ে

জীবনের সাঁচ্চা সোনার জন্যে।

সেদিন ঢেউ ছিল না জলে।

আশ্বিনের রোদ্‌দুর কাঁপছে

সমুদ্রের শিহর-লাগা নীলিমায়।

বাসার ধারে পুরোনো ঝাউগাছে

ধেয়ে আসছে খাপছাড়া হাওয়া,

ঝর্‌ঝর্‌ করে উঠছে তার পাতা।

বেগনি রঙের পাখি, বুকের কাছে সাদা,

টেলিগ্রাফের তারে বসে লেজ দুলিয়ে

ডাকছে মিষ্টি মৃদু চাপা সুরে।

শরৎ-আকাশের নির্মল নীলে ছড়িয়ে আছে

কোন্‌ অনাদি নির্বাসনের গভীর বিষাদ।

মনের মধ্যে হুহু করে উঠছে--

"ফিরে যেতে হবে।"

থেকে থেকে মনে পড়ছে,

সেদিনকার সেই জল-মুছে-ফেলা চোখে

ঝলে উঠেছিল যে আলো।

সেইদিনই চড়লুম জাহাজে।

বন্দরে নেমেই এসেছি চলে।

রাস্তার বাঁকে এসে চাইলেম বাড়ির দিকে;

মনে হল, সেখানে বাস নেই কারও।

এলেম সদর দরজার সামনে,

দেখি তালা বন্ধ।

ধক্‌ করে উঠল বুকের মধ্যে;

বাড়ির ভিতর থেকে শূন্যতার দীর্ঘনিশ্বাস এসে

লাগল আমার অন্তরে।

অনেক সন্ধানের পর

দেখা হল শেষে।

কোন্‌ বারো-ভুঁইঞাদের আমলের

একখানা তিন-কাল-পেরোনো গ্রাম--

একটি পুরোনো দিঘির ধারে --

দিঘির নামেই লোচনদিঘি তার নাম।

সেখানে ভুলে-যাওয়া তারিখের

ঝাপসা-অক্ষর-পটওআলা

ভাঙা দেবালয়।

পূর্বখ্যাতির কোনো সাক্ষী রাখে নি,

আছে সে অশ্বত্থের পাঁজর -ভাঙা

আলিঙ্গনে জড়িয়ে-পড়া।

পাড়ির উপরে বুড়ো বটের তলায়

একটি নূতন আটচালা ঘর,

সেইখানে গ্রামের বালিকাবিদ্যালয়।

দেখলুম অমিয়াকে

ছাই রঙের মোটা শাড়ি পরা,

দুই হাতে দুইগাছি শাঁখা,

পায়ে নেই জুতো,

ঢিলে খোঁপা অযত্নে পড়েছে ঝুলে।

পাড়াগাঁয়ের শ্যামল রঙ লেগেছে মুখে।

ছোটো ঝারি হাতে পাঠশালার বাগানে

জল দিচ্ছে সবজি-খেতে।

ভেবে পেলেম না কী বলি।

তারও মুখে এল না

প্রথম-দেখার কোনো সম্ভাষণ,

কোনো প্রশ্ন।

চোখের আড়ে

আমার দামি জুতোজোড়াটার দিকে তাকিয়ে

বললে অনায়াসে,

"বেশি বর্ষায় আগাছায় চাপা পড়েছে

বিলিতি বেগুনের চারা;

এসো-না, নিড়িয়ে দেবে।"

বোঝা গেল না, ঠাট্টা কি সত্যি।

জামার আস্তিনে ছিল মুক্তোর বোতাম,

লুকিয়ে আস্তিনটা দিলেম উলটিয়ে।

অমিয়ার জন্যে একটা ব্রোচ ছিল পকেটে,

বুঝলেম দিতে গেলে

হীরেটাতে লাগবে প্রহসনের হাসি।

একটু কেসে শুধালেম,

"এখানে থাকো কোথায়।"

ঝারি রেখে দিয়ে বললে, "দেখবে?"

নিয়ে গেল স্কুলের মধ্যে

দালানের পুব দিকটাতে

শতরঞ্জের পর্দা দিয়ে ভাগ করা ঘরে।

একটা তক্তপোশের উপর

বিছানা রয়েছে গোটানো।

টুলের উপর সেলাইয়ের কল,

ছিটের খাপে ঢাকা সেতার

দেয়ালে-ঠেসান-দেওয়া।

দক্ষিণের দরজার সামনে মাদুর পাতা,

তার উপরে ছড়িয়ে আছে

ছাঁটা কাপড়, নানা রঙের ফিতে,

রেশমের মোড়ক।

উত্তর কোণের দেয়ালে

ছোটো টিপায়ে হাত-আয়না,

চিরুনি, তেলের শিশি,

বেতের ঝুড়িতে টুকিটাকি।

দক্ষিণ কোণের দেয়ালের গায়ে

ছোটো টেবিলে লেখবার সামগ্রী

আর রঙ-করা মাটির ভাঁড়ে

একটি স্থলপদ্ম।

অমিয়া বললে, "এই আমার বাসা--

একটু বোসো, আসছি আমি।"

বাইরে জটা-ঝোলা বটের ডালে

ডাকছে কোকিল।

মান-কচুর ঝোপের পাশে

বিষম খেপে উঠেছে একদল ঝগড়াটে শালিখ।

দেখা যায়, ঝিল্‌মিল্‌ করছে

ঢালু পাড়ির তলায়

দিঘির উত্তর ধারের এক টুকরো জল

কলমি-শাকের পাড়-দেওয়া।

চোখে পড়ল, লেখবার টেবিলে একটি ছবি --

অল্প বয়সের যুবা, চিনি নে তাকে--

কয়লায় আঁকা, কাঁচকড়ার ফ্রেমে বাঁধানো

ফলাও তার কপাল, চুল আলুথালু,

চোখে যেন দূর ভবিষ্যতের আলো,

ঠোঁটে যেন কঠিন পণ তালা-আঁটা।

এমন সময় অমিয়া নিয়ে এল

থালায় করে জলখাবার--

চিঁড়ে, কলা, নারকেল-নাড়ু,

কালো পাথর-বাটিতে দুধ,

এক-গেলাস ডাবের জল।

মেঝের উপর থালা রেখে

পশমে-বোনা একটা আসন দিল পেতে।

খিদে নেই বললে মিথ্যে হত না,

রুচি নেই বললে সত্য হত,

কিন্তু খেতেই হল।

তার পরে শোনা গেল খবর।

আমার ব্যবসায়ে আমদানি যখন জমে উঠেছে ব্যাঙ্কে,

যখন হুঁশ ছিল না আর-কোনো জমাখরচে,

তখন অমিয়ার বাবা কুঞ্জকিশোরবাবু

মাঝে মাঝে লক্ষপতির ঘরের

দুর্লভ দুই-একটি ছেলেকে

এনেছিলেন চায়ের টেবিলে।

সব সুযোগই ব্যর্থ করেছে বারে বারে

তাঁর একগুঁয়ে মেয়ে।

কপাল চাপড়ে হাল ছেড়েছেন যখন তিনি

এমন সময় পারিবারিক দিগন্তে

হঠাৎ দেখা দিল কক্ষছাড়া পাগলা জ্যোতিষ্ক--

মাধপাড়ার রায়বাহাদুরের একমাত্র ছেলে মহীভূষণ।

রায়বাহাদুর জমা টাকা আর জমাট বুদ্ধিতে

দেশবিখ্যাত।

তাঁর ছেলেকে কোনো পিতা পারে না হেলা করতে

যতই সে হোক লাগাম-ছেঁড়া।

আট বছর য়ুরোপে কাটিয়ে মহীভূষণ ফিরেছেন দেশে।

বাবা বললেন, "বিষয়কর্ম দেখো।"

ছেলে বললে, "কী হবে।"

লোকে বললে, ওর বুদ্ধির কাঁচা ফলে ঠোকর দিয়েছে

রাশিয়ার লক্ষ্মী-খেদানো বাদুড়টা।

অমিয়ার বাবা বললেন, "ভয় নেই,

নরম হয়ে এল বলে দেশের ভিজে হাওয়ায়।"

দু দিনে অমিয়া হল তার চেলা।

যখন-তখন আসত মহীভূষণ,

আশপাশের হাসাহাসি কানাকানি গায়ে লাগত না কিছুই।

দিনের পর দিন যায়।

অধীর হয়ে অমিয়ার বাবা তুললেন বিয়ের কথা।

মহী বললে, "কী হবে।"

বাবা রেগে বললেন, "তবে তুমি আস কেন রোজ।"

অনায়াসে বললে মহীভূষণ,

"অমিয়াকে নিয়ে যেতে চাই যেখানে ওর কাজ।"

অমিয়ার শেষ কথা এই,

"এসেছি তাঁরই কাজে।

উপকরণের দুর্গ থেকে তিনি করেছেন আমাকে উদ্ধার।"

আমি শুধালেম, "কোথায় আছেন তিনি।"

অমিয়া বললে, "জেলখানায়।"