ভালোবাসার বদলে দয়া

যৎসামান্য সেই দান,

সেটা হেলাফেলারই স্বাদ ভোলানো

পথের পথিকও পারে তা বিলিয়ে দিতে

পথের ভিখারিকে,

শেষে ভুলে যায় বাঁক পেরোতেই।

তার বেশি আশা করি নি সেদিন।

চলে গেলে তুমি রাতের শেষ প্রহরে।

মনে ছিল, বিদায় নিয়ে যাবে,

শুধু বলে যাবে, "তবে আসি।'

যে কথা আর-একদিন বলেছিলে,

যা আর কোনোদিন শুনব না,

তার জায়গায় ওই দুটি কথা,

ওইটুকু দরদের সরু বুনোনিতে যেটুকু বাঁধন পড়ে

তাও কি সইত না তোমার।

প্রথম ঘুম যেমনি ভেঙেছে

বুক উঠেছে কেঁপে,

ভয় হয়েছে সময় বুঝি গেল পেরিয়ে।

ছুটে এলেম বিছানা ছেড়ে।

দূরে গির্জের ঘড়িতে বাজল সাড়ে বারোটা।

রইলেম বসে আমার ঘরের চৌকাঠে

দরজায় মাথা রেখে--

তোমার বেরিয়ে যাবার বারান্দার সামনে।

অতি সামান্য একটুখানি সুযোগ

অভাগীর ভাগ্য তাও নিল ছিনিয়ে,

পড়লেম ঘুমে ঢলে

তুমি যাবার কিছু আগেই।

আড়চোখে বুঝি দেখলে চেয়ে

এলিয়ে-পড়া দেহটা--

ডাঙায়-তোলা ভাঙা নৌকোটা যেন।

বুঝি সাবধানেই গেছ চলে,

ঘুম ভাঙে পাছে।

চমকে জেগে উঠেই বুঝেছি

মিছে হয়েছে জাগা।

বুঝেছি, যা যাবার তা গেছে এক নিমেষেই--

যা পড়ে থাকবার তাই রইল পড়ে

যুগযুগান্তর।

চুপচাপ চারি দিক--

যেমন চুপচাপ পাখিহারা পাখির বাসা।

গানহারা গাছের ডালে।

কৃষ্ণসপ্তমীর মিইয়ে-পড়া জ্যোৎস্নার সঙ্গে মিশেছে

ভোরবেলাকার ফ্যাকাশে আলো,

ছড়িয়ে পড়েছে আমার পাঙাশ-বরণ শূন্য জীবনে।

গেলেম তোমার শোবার ঘরের দিকে

বিনা কারণে।

দরজার বাইরে জ্বলছে

ধোঁওয়ায়-কালি-পড়া হারিকেন লণ্ঠন,

বারান্দায় নিবো-নিবো শিখার গন্ধ।

ছেড়ে-আসা বিছানায় খোলা মশারি

একটু একটু কাঁপছে বাতাসে।

জানলার বাইরের আকাশে

দেখা যায় শুকতারা,

আশা-বিদায় করা

যত ঘুমহারাদের সাক্ষী।

হঠাৎ দেখি ফেলে গেছ ভুলে

সোনাবাঁধানো হাতির দাঁতের লাঠিগাছটা।

মনে হল, যদি সময় থাকে

তবে হয়তো স্টেশন থেকে ফিরে আসবে খোঁজ করতে--

কিন্তু ফিরবে না

আমার সঙ্গে দেখা হয় নি বলে।