মহা-অতীতের সাথে আজ আমি করেছি মিতালি--

দিবালোক-অবসানে তারালোক জ্বালি

ধ্যানে সেথা বসেছে সে

রূপহীন দেশে;

যেথা অস্তসূর্য হতে নিয়ে রক্তরাগ

গুহাচিত্রে করিছে সজাগ

তার তুলি

ম্রিয়মাণ জীবনের লুপ্ত রেখাগুলি;

নিমীলিত বসন্তের ক্ষান্তগন্ধে যেখানে সে

গাঁথিয়া অদৃশ্যমালা পরিছে নিবিড় কালোকেশে;

যেখানে তাহার কণ্ঠহারে

দুলায়েছে সারে সারে

প্রাচীন শতাব্দীগুলি শন্ত-চিত্তদহন বেদনা

মাণিক্যের কণা।

সেথা বসে আছি কাজ ভুলে

অস্তাচলমূলে

ছায়াবীথিকায়।

রূপময় বিশ্বধারা অবলুপ্তপ্রায়

গোধূলিধূসর আবরণে,

অতীতের শূন্য তার সৃষ্টি মেলিতেছে মোর মনে।

এ শূন্য তো মরুমাত্র নয়,

এ যে চিত্তময়;

বর্তমান যেতে যেতে এই শূন্যে যায় ভ'রে রেখে

আপন অন্তর থেকে

অসংখ্য স্বপন;

অতীত এ শূন্য দিয়ে করেছি বপন

বস্তুহীন সৃষ্টি যত,

নিত্যকাল-মাঝে তারি ফলশস্য ফলিছে নিয়ত।

আলোড়িত এই শূন্য যুগে যুগে উঠিয়াছে জ্বলি,

ভরিয়াছে জ্যোতির অঞ্জলি।

বসে আছি নির্নিমেষ চোখে

অতীতের সেই ধ্যানালোকে--

নি:শব্দ তিমিরতটে জীবনের বিস্মৃত রাতির।

হে অতীত,

শান্ত তুমি নির্বাণ-বাতির

অন্ধকারে,

সুখদুখনিষ্কৃতির পারে।

শিল্পী তুমি, আঁধারের ভূমিকায়

নিভৃতে রচিছ সৃষ্টি নিরাসক্ত নির্মম কলায়,

স্মরণে ও বিস্মরণে বিগলিত বর্ণ দিয়া লিখা

বর্ণিতেছ আখ্যায়িকা;

পুরাতন ছায়াপথে নূতন তারার মতো

উজ্জ্বলি উঠিছে কত,

কত তার নিভাইছ একেবারে

যুগান্তের অশান্ত ফুৎকারে।

আজ আমি তোমার দোসর,

আশ্রয় নিতেছি সেথা যেথা আছে মহা-অগোচর।

তব অধিকার আজি দিনে দিনে ব্যাপ্ত হয়ে আসে

আমার আয়ুর ইতিহাসে।

সেথা তব সৃষ্টির মন্দিরদ্বারে

আমার রচনাশালা স্থাপন করেছি একধারে

তোমারি বিহারবনে ছায়াবীথিকায়।

ঘুচিল কর্মের দায়,

ক্লান্ত হল লোকমুখে খ্যাতির আগ্রহ;

দুঃখ যত সয়েছি দুঃসহ

তাপ তার করি অপগত

মূর্তি তারে দিব নানামতো

আপনার মনে মনে।

কলকোলাহলশান্ত জনশূন্য তোমার প্রাঙ্গণে,

যেখানে মিটেছে দ্বন্দ্ব মন্দ ও ভালোয়,

তারার আলোয়

সেখানে তোমার পাশে আমার আসন পাতা--

কর্মহীন আমি সেথা বন্ধহীন সৃষ্টির বিধাতা।