আপন মনে বেড়ায় গান গেয়ে,

গান কেউ শোনে কেউ শোনে না।

ঘুরে বেড়ায় জগৎ-পানে চেয়ে,

তারে কেউ দেখে কেউ দেখে না।

সে যেন গানের মতো প্রাণের মতো শুধু

সৌরভের মতো উড়ছে বাতাসেতে,

আপনারে আপনি সে জানে না,

তবু আপনাতে আপনি আছে মেতে।

হরষে তার পুলকিত গা,

ভাবের ভরে টলমল পা,

কে জানে কোথায় যে সে যায়

আঁখি তার দেখে কি দেখে না।

লতা তার গায়ে পড়ে,

ফুল তার পায়ে পড়ে,

নদীর মুখে কুলু কুলু রা'।

গায়ের কাছে বাতাস করে বা'।

সে শুধু চলে যায়,

মুখে কী বলে যায়,

বাতাস গলে যায় তা শুনে।

সুমুখে আঁখি রেখে

চলেছে কোথা যে কে

কিছু সে নাহি দেখে শোনে।

যেখান দিয়ে যায় সে চলে সেথায় যেন ঢেউ খেলে যায়,

বাতাস যেন আকুল হয়ে ওঠে,

ধরা যেন চরণ ছুঁয়ে শিউরে ওঠে শ্যামল দেহে

লতায় যেন কুসুম ফোটে ফোটে।

বসন্ত তার সাড়া পেয়ে সখা ব'লে আসে ধেয়ে,

বনে যেন দুইটি বসন্ত।

দুই সখাতে ভেসে চলে যৌবনসাগরের জলে,

কোথাও যেন নাহি রে তার অন্ত।

আকাশ বলে "এসো এসো ', কানন বলে "বোসো বোসো ',

সবাই যেন নাম ধরে তার ডাকে।

হেসে যখন কয় সে কথা মূর্ছা যায় রে বনের লতা,

লুটিয়ে ভুঁয়ে চুপ করে সে থাকে।

বনের হরিণ কাছে আসে সাথে সাথে ফিরে পাশে

স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায় দেহছায়।

পায়ের কাছে পড়ে লুটি, বড়ো বড়ো নয়ন দুটি

তুলে তুলে মুখের পানে চায়।

আপনা-ভোলা সরল হাসি ঝরে পড়ছে রাশি রাশি,

আপনি যেন জানতে নাহি পায়।

লতা তারে আটকে রেখে তারি কাছে হাসতে শেখে,

হাসি যেন কুসুম হয়ে যায়।

গান গায় সে সাঁঝের বেলা, মেঘগুলি তাই ভুলে খেলা

নেমে আসতে চায় রে ধরা পানে,

একে একে সাঁঝের তারা গান শুনে তার অবাক-পারা

আর সবারে ডেকে ডেকে আনে।

আপনি মাতে আপন স্বরে, আর সবারে পাগল করে,

সাথে সাথে সবাই গাহে গান--

জগতের যা-কিছু আছে সব ফেলে দেয় পায়ের কাছে,

প্রাণের কাছে খুলে দেয় সে প্রাণ।

তোরাই শুধু শুনলি নে রে, কোথায় বসে রইলি যে রে,

দ্বারের কাছে গেল গেয়ে গেয়ে,

কেউ তাহারে দেখলি নে তো চেয়ে।

গাইতে গাইতে চলে গেল, কত দূর সে চলে গেল,

গানগুলি তার হারিয়ে গেল বনে,

দুয়ার দেওয়া তোদের পাষাণ-মনে।