শালবনের ওই আঁচল ব্যেপে

যেদিন হাওয়া উঠত খেপে

ফাগুন-বেলার বিপুল ব্যাকুলতায়,

যেদিন দিকে দিগন্তরে

লাগত পুলক কী মন্তরে

কচি পাতার প্রথম কলকথায়,

সেদিন মনে হত কেন

ওই ভাষারই বাণী যেন

লুকিয়ে আছে হৃদয়কুঞ্জছায়ে;

তাই অমনি নবীন রাগে

কিশলয়ের সাড়া লাগে

শিউরে-ওঠা আমার সারা গায়ে।

আবার যেদিন আশ্বিনেতে

নদীর ধারে ফসল-খেতে

সূর্য-ওঠার রাঙা-রঙিন বেলায়

নীল আকাশের কূলে কূলে

সবুজ সাগর উঠত দুলে

কচি ধানের খামখেয়ালি খেলায়--

সেদিন আমার হত মনে

ওই সবুজের নিমন্ত্রণে

যেন আমার প্রাণের আছে দাবি;

তাই তো হিয়া ছুটে পালায়

যেতে তারি যজ্ঞশালায়,

কোন্‌ ভুলে হায় হারিয়েছিল চাবি।



কার কথা এই আকাশ বেয়ে

ফেলে আমার হৃদয় ছেয়ে,

বলে দিনে, বলে গভীর রাতে--

"যে-জননীর কোলের 'পরে

জন্মেছিলি মর্ত-ঘরে,

প্রাণ ভরা তোর যাহার বেদনাতে,

তাহার বক্ষ হতে তোরে

কে এনেছে হরণ করে,

ঘিরে তোরে রাখে নানান পাকে।

বাঁধন-ছেঁড়া তোর সে নাড়ী

সইবে না এই ছাড়াছাড়ি,

ফিরে ফিরে চাইবে আপন মাকে।'

শুনে আমি ভাবি মনে

তাই ব্যথা এই অকারণে,

প্রাণের মাঝে তাই তো ঠেকে ফাঁকা,

তাই বাজে কার করুণ সুরে--

"গেছিস দূরে অনেক দূরে',

কী যেন তাই চোখের 'পরে ঢাকা।

তাই এতদিন সকল খানে

কিসের অভাব জাগে প্রাণে

ভালো করে পাই নি তাহা বুঝে;

ফিরেছি তাই নানামতে

নানান হাটে নানান পথে

হারানো কোল কেবল খুঁজে খুঁজে।



আজকে খবর পেলেম খাঁটি -

মা আমার এই শ্যামল মাটি,

অন্নে ভরা শোভার নিকেতন;

অভ্রভেদী মন্দিরে তার

বেদী আছে প্রাণদেবতার,

ফুল দিয়ে তার নিত্য আরাধন।

এইখানে তার অঙ্ক-মাঝে

প্রভাতরবির শঙ্খ বাজে,

আলোর ধারায় গানের ধারা মেশে;

এইখানে সে পূজার কালে

সন্ধ্যারতির প্রদীপ জ্বালে

শান্ত মনে ক্লান্ত দিনের শেষে।

হেথা হতে গেলেম দূরে

কোথা যে ইঁটকাঠের পুরে

বেড়া-ঘেরা বিষম নির্বাসনে;

তৃপ্তি যে নাই, কেবল নেশা,

ঠেলাঠেলি, নাই তো মেশা,

আবর্জনা জমে উপার্জনে।

যন্ত্র-জাঁতায় পরান কাঁদায়,

ফিরি ধনের গোলকধাঁধায়,

শূন্যতারে সাজাই নানা সাজে;

পথ বেড়ে যায় ঘুরে ঘুরে,

লক্ষ্য কোথায় পালায় দূরে,

কাজ ফলে না অবকাশের মাঝে।



যাই ফিরে যাই মাটির বুকে,

যাই চলে যাই মুক্তি-সুখে,

ইঁটের শিকল দিই ফেলে দিই টুটে;

আজ ধরণী আপন হাতে

অন্ন দিলেন আমার পাতে,

ফল দিয়েছেন সাজিয়ে পত্রপুটে।

আজকে মাঠের ঘাসে ঘাসে

নিশ্বাসে মোর খবর আসে

কোথায় আছে বিশ্বজনের প্রাণ;

ছয় ঋতু ধায় আকাশ-তলায়,

তার সাথে আর আমার চলায়

আজ হতে না রইল ব্যবধান।

যে দূতগুলি গগনপারের,

আমার ঘরের রুদ্ধ দ্বারের

বাইরে দিয়েই ফিরে ফিরে যায়,

আজ হয়েছে খোলাখুলি

তাদের সাথে কোলাকুলি

মাঠের ধারে পথতরুর ছায়।

কী ভুল ভুলেছিলেম, আহা,

সব চেয়ে যা নিকট তাহা

সুদূর হয়ে ছিল এতদিন;

কাছেকে আজ পেলেম কাছে--

চার দিকে এই যে ঘর আছে

তার দিকে আজ ফিরল উদাসীন।