শোনো শোনো ওগো বকুল-বনের পাখি,

দেখো তো, আমায় চিনিতে পারিবে না কি।

নই আমি কবি, নই জ্ঞান-অভিমানী,

মান-অপমান কী পেয়েছি নাহি জানি,

দেখেছ কি মোর দূরে-যাওয়া মনখানি--

উড়ে-যাওয়া মোর আঁখি?

আমাতে কি কিছু দেখেছ তোমারি সম,

অসীম-নীলিমা-তিয়াষি বন্ধু মম?

শোনো শোনো ওগো বকুল-বনের পাখি,

কবে দেখেছিলে মনে পড়ে সে কথা কি?

বালক ছিলাম, কিছু নহে তার বাড়া,

রবির আলোর কোলেতে ছিলেম ছাড়া,

চাঁপার গন্ধ বাতাসের-প্রাণ-কাড়া

যেত মোরে ডাকি ডাকি।

সহজ রসের ঝরনা-ধারার 'পরে

গান ভাসাতেম সহজ সুখের ভরে।

শোনো শোনো ওগো বকুল-বনের পাখি,

কাছে এসেছিনু ভুলিতে পারিবে তা কি।

নগ্ন পরান লয়ে আমি কোন্‌ সুখে

সারা আকাশের ছিনু যেন বুকে বুকে,

বেলা চলে যেত অবিরত কৌতুকে

সব কাজে দিয়ে ফাঁকি।

শ্যামলা ধরার নাড়ীতে যে তাল বাজে

নাচিত আমার অধীর মনের মাঝে।

শোনো শোনো ওগো বকুল-বনের পাখি,

দূরে চলে এনু, বাজে তার বেদনা কি?

আষাঢ়ের মেঘ রহে না কি মোরে চাহি।

সেই নদী যায় সেই কলতান গাহি--

তাহার মাঝে কি আমার অভাব নাহি।

কিছু কি থাকে না বাকি।

বালক গিয়েছে হারায়ে, সে কথা লয়ে

কোনো আঁখিজল যায় নি কোথাও বয়ে?

শোনো শোনো ওগো বকুল-বনের পাখি,

আর-বার তারে ফিরিয়া ডাকিবে না কি।

যায় নি সেদিন যেদিন আমারে টানে,

ধরার খুশিতে আছে সে সকলখানে;

আজ বেঁধে দাও আমার শেষের গানে

তোমার গানের রাখী।

আবার বারেক ফিরে চিনে লও মোরে,

বিদায়ের আগে লও গো আপন ক'রে।

শোনো শোনো ওগো বকুল-বনের পাখি,

সেদিন চিনেছ আজিও চিনিবে নাকি।

পারঘাটে যদি যেতে হয় এইবার,

খেয়াল-খেয়ায় পাড়ি দিয়ে হব পার,

শেষের পেয়ালা ভরে দাও হে আমার

সুরের সুরার সাকী।

আর কিছু নই, তোমারি গানের সাথি,

এই কথা জেনে আসুক ঘুমের রাতি।

শোনো শোনো ওগো বকুল-বনের পাখি,

মুক্তির টিকা ললাটে দাও তো আঁকি।

যাবার বেলায় যাব না ছদ্মবেশে,

খ্যাতির মুকুট খসে যাক নিঃশেষে,

কর্মের এই বর্ম যাক-না ফেঁসে,

কীর্তি যাক-না ঢাকি।

ডেকে লও মোরে নামহারাদের দলে

চিহ্নবিহীন উধাও পথের তলে।

শোনো শোনো ওগো বকুল-বনের পাখি,

যাই যবে যেন কিছুই না যাই রাখি।

ফুলের মতন সাঁঝে পড়ি যেন ঝরে,

তারার মতন যাই যেন রাত-ভোরে,

হাওয়ার মতন বনের গন্ধ হ'রে

চলে যাই গান হাঁকি।

বেণুপল্লবমর্মররব-সনে

মিলাই যেন গো সোনার গোধূলিখনে।