আমরা ছিলেম প্রতিবেশী।

যখন-তখন দুই বাসার সীমা ডিঙিয়ে

যা-খুশি করে বেড়াত কনি,

খালি পা, খাটো-ফ্রক-পরা মেয়ে;

দুষ্টু চোখদুটো।

যেন কালো আগুনের ফিনকি-ছড়ানো।

ছিপ্‌ছিপে শরীর।

ঝাঁকড়া চুল চায় না শাসন মানতে,

বেণী বাঁধতে মাকে পেতে হত দুঃখ।

সঙ্গে সঙ্গে সারাক্ষণ লাফিয়ে বেড়াত

কোঁকড়া-লোম-ওআলা বেঁটে জাতের কুকুরটা--

ছন্দের মিলে বাঁধা।

দুজনে যেন একটি দ্বিপদী।

আমি ছিলেম ভালো ছেলে

ক্লাসের দৃষ্টান্তস্থল।

আমার সেই শ্রেষ্ঠতার

কোনো দাম ছিল না ওর কাছে।

যে বছর প্রোমোশন পাই দু ক্লাস ডিঙিয়ে

লাফিয়ে গিয়ে ওকে জানাই,

ও বলে, "ভারি তো!

কী বলিস টেমি।"

ওর কুকুরটা ডেকে ওঠে,

"ঘেউ।"

ও ভালোবাসত হঠাৎ ভাঙতে আমার দেমাক,

রুখিয়ে তুলতে ঠাণ্ডা ছেলেটাকে;

যেমন ভালোবাসত

দম্‌ করে ফাটিয়ে দিতে মাছের পটকা।

ওকে জব্দ করার চেষ্টা

ঝরনার গায়ে নুড়ি ছুঁড়ে মারা।

কলকল হাসির ধারায়

বাধা দিত না কিছুতেই।

মুখস্ত করতে বসেছি সংস্কৃত শব্দরূপ

চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে;

ও হঠাৎ কখন দুম করে

পিঠে মেরে গেল কিল

অত্যন্ত প্রাকৃত রীতিতে।

সংস্কৃতের অপভ্রংশ

মুখ থেকে ভ্রষ্ট হবার পূর্বেই

বেণীটুকুর দোলন দেখিয়ে দিল দৌড়।

মেয়ের হাতের সহাস্য অপমান

সহজে সম্ভোগ করবার বয়স

তখনো আমার ছিল অল্প দূরে।

তাই শাসনকর্তা ছুটত ওর অনুসরণে,

প্রায় পৌঁছতে পারে নি লক্ষ্যে।

ওর বিলীয়মান শব্দভেদী হাসি

শুনেছি দূর থেকে,

হাতের কাছে পাই নি

কোনো দায়িত্ববিশিষ্ট জীব--

কোনো বেদনাবিশিষ্ট সত্তা।

এমনিতরো ছিল আমাদের আদ্যযুগ,

ছোটোমেয়ের উৎপাতে ব্যতিব্যস্ত।

দুরন্তকে শাসনের ইচ্ছা করেছি

পুরুষোচিত অসহিষ্ণুতায়;

শুনেছি ব্যর্থচেষ্টার জবাবে

তীব্রমধুর কণ্ঠে,

"দুয়ো দুয়ো দুয়ো।"

বাইরে থেকে হারের পরিমাণ

বেড়ে চলেছে যখন

তখন হয়তো জিত হয়েছে শুরু

ভিতর থেকে।

সেই বেতার-বার্তার কান খোলে নি তখনো,

যদিও প্রমাণ হচ্ছিল জড়ো।

ইতিমধ্যে আমাদের জীবননাট্যে

সাজ হয়েছে বদল।

ও পরেছে শাড়ি,

আঁচলে বিঁধিয়েছে ব্রোচ,

বেণী জড়িয়েছে হাল ফেশানের খোঁপায়।

আমি ধরেছি থাকি রঙের খাটো প্যান্ট্‌

আর খেলোয়াড়ের জামা

ফুটবল-বলরামের নকলে।

ভিতরের দিকে ভাবের হাওয়ারও

বদল হল শুরু,

কিছু তার পাওয়া যায় পরিচয়।

একদিন কনির বাবা পড়ছেন বসে

ইংরেজি সাপ্তাহিক।

বড়ো লোভ আমার ওই ছবির কাগজটার 'পরে।

আমি লুকিয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে দেখছি

উড়ো জাহাজের নক্‌শা।

জানতে পেরে তিনি উঠলেন হেসে।

তিনি ভাবতেন, ছেলেটার বিদ্যার দম্ভ বেশি।

সেটা তাঁরও ছিল ব'লেই

আর কারও পারতেন না সইতে।

কাগজখানা তুলে ধরে বললেন,

"বুঝিয়ে দাও তো বাপু, এই ক'টা লাইন,

দেখি তোমার ইংরেজি বিদ্যে।"

নিষ্ঠুর অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে

মুখ লাল করে উঠতে হল ঘেমে।

ঘরের এক কোণে বসে

একলা করছিল কড়িখেলা

আমার অপমানের সাক্ষী কনি।

দ্বিধা হল না পৃথিবী,

অবিচলিত রইল চার দিকের নির্মম জগৎ।

পরদিন সকালে উঠে দেখি,

সেই কাগজখানা আমার টেবিলে--

শিবরামবাবুর ছবির কাগজ।

এত বড়ো দুঃসাহসের গভীর রসের উৎস কোথায়,

তার মূল্য কত,

সেদিন বুঝতে পারে নি বোকা ছেলে।

ভেবেছিলেম, আমার কাছে কনির

এ শুধু স্পর্ধার বড়াই।

দিনে দিনে বয়স বাড়ছে

আমাদের দুজনের অগোচরে,

তার জন্যে দায়িক নই আমরা।

বয়স-বাড়ার মধ্যে অপরাধ আছে

এ কথা লক্ষ্য করি নি নিজে,

করেছেন শিবরামবাবু।

আমাকে স্নেহ করতেন কনির মা,

তার জবাবে ঝাঁঝিয়ে উঠত তাঁর স্বামীর প্রতিবাদ।

একদিন আমার চেহারা নিয়ে খোঁটা দিয়ে

শিবরামবাবু বলছিলেন তাঁর স্ত্রীকে,

আমার কানে গেল--

"টুকটুকে আমের মতো ছেলে

পচতে করে না দেরি,

ভিতরে পোকার বাসা।"

আমার 'পরে ওঁর ভাব দেখেবাবা প্রায় বলতেন রেগে,

"লক্ষ্মীছাড়া, কেন যাস ওদের বাড়ি।"

ধিক্কার হত মনে,

বলতেম দাঁত কামড়ে,

"যাব না আর কক্‌খনো।"

যেতে হত দুদিন বাদেই

কুলতলার গলি দিয়ে লুকিয়ে।

মুখ বাঁকিয়ে বসে রইত কনি

দুদিন না-আসার অপরাধে।

হঠাৎ বলে উঠত,

"আড়ি, আড়ি, আড়ি।"

আমি বলতুম, "ভারি তো।"

ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাতুম আকাশের দিকে।

একদিন আমাদের দুই বাড়িতেই এল

বাসা ভাঙবার পালা।

এঞ্জিনিয়র শিবরামবাবু যাবেন পশ্চিমে

কোন্‌ শহরে আলো-জ্বালার কারবারে।

আমরা চলেছি কলকাতায়;

গ্রামের ইস্কুলটা নয় বাবার মনের মতো।

চলে যাবার দুদিন আগে

কনি এসে বললে, "এস আমাদের বাগানে।"

আমি বললাম "কেন।"

কনি বললে, "চুরি করব দুজনে মিলে;

আর তো পাব না এমন দিন।"

বললেম, "কিন্তু তোমার বাবা--"

কনি বললে, "ভীতু।"

আমি বললেম মাথা বাঁকিয়ে,

"একটুও না।"

শিবরামবাবুর শখের বাগান ফলে আছে ভরে।

কনি শুধোল, "কোন্‌ ফল ভালোবাস সব চেয়ে।"

আমি বললেম, "ওই মজঃফরপুরের লিচু।"

কনি বললে, "গাছে চড়ে পাড়তে থাকো,

ধরে রইলেম ঝুড়ি।"

ঝুড়ি প্রায় ভরেছে,

হঠাৎ গর্জন উঠল "কে রে"--

স্বয়ং শিবরামবাবু।

বললেন, "আর কোনো বিদ্যা হবে না বাপু,

চুরি বিদ্যাই শেষ ভরসা।"

ঝুড়িটা নিয়ে গেলেন তিনি

পাছে ফলবান হয় পাপের চেষ্টা।

কনির দুই চোখ দিয়ে

মোটা মোটা ফোঁটায়

জল পড়তে লাগল নিঃশব্দে;

গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে

অমন অচঞ্চল কান্না

দেখি নি ওর কোনোদিন।

তার পরে মাঝখানে অনেকখানি ফাঁক।

বিলেত থেকে ফিরে এসে দেখি

কনির হয়েছে বিয়ে।

মাথায় উঠেছে লালপেড়ে আঁচল।

কপালে কুঙ্কুম,

শান্তগভীর চোখের দৃষ্টি,

স্বর হয়েছে গম্ভীর।

আমি কলকাতায় রসায়নের কারখানায়

ওষুধ বানিয়ে থাকি।

আমার দিনের পর দিন চলেছে

কর্মচক্রের স্নেহহীন কর্কশধ্বনিতে।

একদিন কনির কাছ থেকে চিঠিতে এল

দেখা করতে অনুনয়।

গ্রামের বাড়িতে ভাগনির বিয়ে,

স্বামী পায় নি ছুটি,

ও একা এসেছে মায়ের কাছে।

বাবা গেছেন হুঁশিয়ারপুরে

বিবাহে মতবিরোধের আক্রোশে।

অনেক দিন পরে এসেছি গ্রামে,

এসেছি প্রতিবেশিনীর সেই বাড়িতে।

ঘাটের পাশে ঢালু পাড়িতে

ঝুঁকে রয়েছে সেই হিজল গাছ জলের দিকে,

পুকুর থেকে আসছে

সেই পুরোনো কালের মিষ্টি গন্ধ শ্যাওলার।

আর সিসুগাছের ডালে দুলছে

সেই দোলনাটা আজও।

কনি প্রণাম করে বললে,"অমলদাদা,

থাকি দূর দেশে,

ভাইফোঁটার দিনে পাব তোমায় নেই সে আশা।

আজ অদিনে মেটাব আমার সাধ, তাই ডেকেছি।"

বাগানে আসন পড়েছে অশত্থতলার চাতালে।

অনুষ্ঠান হল সারা;

পায়ের কাছে কনি রাখলে একটি ঝুড়ি,

সে ঝুড়ি লিচুতে ভরা।

বললে, "সেই লিচু।"

আমি বললেম, "ঠিক সে লিচু নয় বুঝি।"

কনি বললে,"কী জানি।"

বলেই দ্রুত গেল চলে।