আমাকে শুনতে দাও,

আমি কান পেতে আছি।

পড়ে আসছে বেলা;

পাখিরা গেয়ে নিচ্ছে দিনের শেষে

কণ্ঠের সঞ্চয় উজাড়-করে-দেবার গান।

ওরা আমার দেহ-মনকে নিল টেনে

নানা সুরের, নানা রঙের,

নানা খেলার

প্রাণের মহলে।

ওদের ইতিহাসের আর কোনো সাড়া নেই,

কেবল এইটুকু কথা--

আছি, আমরা আছি, বেঁচে আছি,

বেঁচে আছি এই আশ্চর্য মুহূর্তে।--

এই কথাটুকু পৌঁছল আমার মর্মে।

বিকালবেলায় মেয়েরা জল ভরে নিয়ে যায় ঘটে,

তেমনি করে ভরে নিচ্ছি প্রাণের এই কাকলি

আকাশ থেকে

মনটাকে ডুবিয়ে দিয়ে।

আমাকে একটু সময় দাও।

আমি মন পেতে আছি।

ভাঁটা-পড়া বেলায়,

ঘাসের উপরে ছড়িয়ে-পড়া বিকেলের আলোতে

গাছেদের নিস্তব্ধ খুশি,

মজ্জার মধ্যে লুকোনো খুশি,

পাতায় পাতায় ছড়ানো খুশি।

আমার প্রাণ নিজেকে বাতাসে মেলে দিয়ে

নিচ্ছে বিশ্বপ্রাণের স্পর্শরস

চেতনার মধ্যে দিয়ে ছেঁকে।

এখন আমাকে বসে থাকতে দাও,

আমি চোখ মেলে থাকি।

তোমরা এসেছ তর্ক নিয়ে।

আজ দিনান্তের এই পড়ন্ত রোদ্দুরে

সময় পেয়েছি একটুখানি;

এর মধ্যে ভালো নেই, মন্দ নেই,

নিন্দা নেই, খ্যাতি নেই।

দ্বন্দ্ব নেই, দ্বিধা নেই--

আছে বনের সবুজ,

জলের ঝিকিমিকি--

জীবনস্রোতের উপর তলে

অল্প একটু কাঁপন, একটু কল্লোল,

একটু ঢেউ।

আমার এই একটুখানি অবসর

উড়ে চলেছে

ক্ষণজীবী পতঙ্গের মতো

সূর্যাস্তবেলার আকাশে

রঙিন ডানার শেষ খেলা চুকিয়ে দিতে--

বৃথা প্রশ্ন কোরো না।

বৃথা এনেছ তোমাদের যত দাবি।

আমি বসে আছি বর্তমানের পিছন মুখে

অতীতের দিকে গড়িয়ে-পড়া ঢালুতটে।

নানান বেদনায় ধেয়ে-বেড়ানো প্রাণ

একদিন করে গেছে লীলা

ওই বনবীথির ডাল দিয়ে বিনুনি-করা

আলোছায়ায়।

আশ্বিনে দুপুর বেলা

এই কাঁপনলাগা ঘাসের উপর,

মাঠের পারে, কাশের বনে,

হাওয়ায় হাওয়ায় স্বগত উক্তি

মিলেছে আমার জীবনবীণার ফাঁকে ফাঁকে।

যে সমস্যাজাল

সংসারের চারি দিকে পাকে-পাকে জড়ানো

তার সব গিঁঠ গেছে ঘুচে।

যাবার পথের যাত্রী পিছনে যায় নি ফেলে

কোনো উদ্‌যোগ, কোনো উদ্‌বেগ, কোনো আকাঙক্ষা;

কেবল গাছের পাতার কাঁপনে

এই বাণীটি রয়ে গেছে--

তারাও ছিল বেঁচে,

তারা যে নেই তার চেয়ে সত্য ওই কথাটি।

শুধু আজ অনুভবে লাগে

তাদের কাপড়ের রঙের আভাস,

পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার হাওয়া,

চেয়ে দেখার বাণী,

ভালোবাসার ছন্দ--

প্রাণগঙ্গার পূর্বমুখী ধারায়

পশ্চিম প্রাণের যমুনার স্রোত।