আমাদের কালে গোষ্ঠে যখন সাঙ্গ হল

সকালবেলার প্রথম দোহন,

ভোরবেলাকার ব্যাপারীরা

চুকিয়ে দিয়ে গেল প্রথম কেনা বেচা,

তখন কাঁচা রৌদ্রে বেরিয়েছি রাস্তায়,

ঝুড়ি হাতে হেঁকেছি আমার কাঁচা ফল নিয়ে--

তাতে কিছু হয়তো ধরেছিল রঙ, পাক ধরে নি।

তার পর প্রহরে প্রহরে ফিরেছি পথে পথে;

কত লোক কত বললে, কত নিলে, কত ফিরিয়ে দিলে,

ভোগ করলে দাম দিলে না, সেও কত লোক--

সে কালের দিন হল সারা।

কাল আপন পায়ের চিহ্ন যায় মুছে মুছে,

স্মৃতির বোঝা আমরাই বা জমাই কেন,

এক দিনের দায় টানি কেন আর-এক দিনের 'পরে,

দেনা-পাওনা চুকিয়ে দিয়ে হাতে হাতে

ছুটি নিয়ে যাই না কেন সামনের দিকে চেয়ে।

সেদিনকার উদ্‌বৃত্ত নিয়ে নূতন কারবার জমবে না

তা নিলেম মেনে।

তাতে কী বা আসে যায়।

দিনের পর দিন পৃথিবীর বাসাভাড়া

দিতে হয় নগদ মিটিয়ে।

তার পর শেষ দিনে দখলের জোর জানিয়ে

তালা বন্ধ করবার ব্যর্থ প্রয়াস,

কেন সেই মূঢ়তা।

তাই প্রথম ঘণ্টা বাজল যেই

বেরিয়েছিলেম হিসেব চুকিয়ে দিয়ে।

দরজার কাছ পর্যন্ত এসে যখন ফিরে তাকাই,

তখন দেখি তুমি যে আছ

এ কালের আঙিনায় দাঁড়িয়ে।

তোমার সঙ্গীরা একদিন যখন হেঁকে বলবে

আর আমাকে নেই প্রয়োজন,

তখন ব্যথা লাগবে তোমারই মনে

এই আমার ছিল ভয়--

এই আমার ছিল আশা।

যাচাই করতে আস নি তুমি--

তুমি দিলে গ্রন্থি বেঁধে তোমার কালে আমার কালে হৃদয় দিয়ে।

দেখলেম ওই বড়ো বড়ো চোখের দিকে তাকিয়ে,

করুণ প্রত্যাশা তো এখনো তার পাতায় আছে লেগে।

তাই ফিরে আসতে হল আর একবার।

দিনের শেষে নতুন পালা আবার করেছি শুরু

তোমারি মুখ চেয়ে,

ভালোবাসার দোহাই মেনে।

আমার বাণীকে দিলেম সাজ পরিয়ে

তোমাদের বাণীর অলংকারে--

তাকে রেখে দিয়ে গেলেম পথের ধারে পান্থশালায়,

পথিক বন্ধু, তোমারি কথা মনে ক'রে।

যেন সময় হলে একদিন বলতে পার

মিটল তোমাদেরও প্রয়োজন,

লাগল তোমাদেরও মনে।

দশ জনের খ্যাতির দিকে হাত বাড়াবার দিন নেই আমার।

কিন্তু তুমি আমাকে বিশ্বাস করেছিলে প্রাণের টানে--

সেই বিশ্বাসকে কিছু পাথেয় দিয়ে যাব এই ইচ্ছা।

যেন গর্ব করে বলতে পার

আমি তোমাদেরও বটে,

এই বেদনা মনে নিয়ে নেমেছি এই কালে--

এমন সময় পিছন ফিরে দেখি তুমি নেই।

তুমি গেলে সেইখানেই

যেখানে আমার পুরোনো কাল অবগুণ্ঠিত মুখে চলে গেল,

যেখানে পুরাতনের গান রয়েছে চিরন্তন হয়ে।

আর, একলা আমি আজও এই নতুনের ভিড়ে বেড়াই ধাক্কা খেয়ে,

যেখানে আজ আছে কাল নেই।