আমারে যে ডাক দেবে এ জীবনে তারে বারংবার

ফিরেছি ডাকিয়া।

সে নারী বিচিত্র বেশে মৃদু হেসে খুলিয়াছে দ্বার

থাকিয়া থাকিয়া।

দীপখানি তুলে ধ'রে, মুখে চেয়ে, ক্ষণকাল থামি

চিনেছে আমারে।

তারি সেই চাওয়া, সেই চেনার আলোক দিয়ে আমি

চিনি আপনারে।

সহস্রের বন্যাস্রোতে জন্ম হতে মৃত্যুর আঁধারে

চলে যাই ভেসে।

নিজেরে হারায়ে ফেলি অস্পষ্টের প্রচ্ছন্ন পাথারে

কোন্‌ নিরুদ্দেশে।

নামহীন দীপ্তিহীন তৃপ্তিহীন আত্মবিস্মৃতির

তমসার মাঝে।

কোথা হতে অকস্মাৎ কর মোরে খুঁজিয়া বাহির

তাহা বুঝি না যে।

তব কণ্ঠে মোর নাম যেই শুনি, গান গেয়ে উঠি--

"আছি, আমি আছি।'

সেই আপনার গানে লুপ্তির কুয়াশা ফেলে টুটি

বাঁচি, আমি বাঁচি।

তুমি মোরে চাও যবে অব্যক্তের অখ্যাত আবাসে

আলো উঠে জ্বলে--

অসাড়ের সাড়া জাগে, নিশ্চল তুষার গলে আসে

নৃত্যকলরোলে।

নিঃশব্দচরণে উষা নিখিলের সুপ্তির দুয়ারে

দাঁড়ায় একাকী,

রক্ত-অবগুণ্ঠনের অন্তরালে নাম ধরি কারে

চলে যায় ডাকি।

অমনি প্রভাত তার বীণা হাতে বাহিরিয়া আসে,

শূন্য ভরে গানে;

ঐশ্বর্য ছড়ায়ে দেয় মুক্তহস্তে আকাশে আকাশে,

ক্লান্তি নাহি জানে।

কোন্‌ জ্যোতির্ময়ী হোথা অমরাবতীর বাতায়নে

রচিতেছে গান

আলোকের বর্ণে বর্ণে; নির্নিমেষ উদ্দীপ্ত নয়নে

করিছে আহ্বান।

তাই তো চাঞ্চল্য জাগে মাটির গভীর অন্ধকারে;

রোমাঞ্চিত তৃণে।

ধরণী ক্রন্দিয়া উঠে, প্রাণস্পন্দ ছুটে চারিধারে

বিপিনে বিপিনে।

তাই তো গোপন ধন খুঁজে পায় অকিঞ্চন ধূলি

নিরুদ্ধ ভাণ্ডারে।

বর্ণে গন্ধে রূপে রসে আপনার দৈন্য যায় ভুলি

পত্রপুষ্পভারে।

দেবতার প্রাথর্নায় কার্পণ্যের বন্ধ মুষ্টি খুলে,

রিক্ততারে টুটি

রহস্যসমুদ্রতলে উন্মথিয়া উঠে উপকূলে

রত্ন মুঠি মুঠি।

তুমি সে আকাশভ্রষ্ট প্রবাসী আলোক, হে কল্যাণী,

দেবতার দূতী।

মর্তের গৃহের প্রান্তে বহিয়া এনেছে তব বাণী

স্বর্গের আকূতি।

ভঙ্গুর মাটির ভাণ্ডে গুপ্ত আছে যে অমৃতবারি

মৃত্যুর আড়ালে,

দেবতার হয়ে হেথা তাহারি সন্ধানে তুমি, নারী,

দু বাহু বাড়ালে।

তাই তো কবির চিত্তে কল্পলোকে টুটিল অর্গল

বেদনার বেগে,

মানসতরঙ্গতলে বাণীর সংগীতশতদল

নেচে ওঠে জেগে।

সুপ্তির তিমিরবক্ষ দীর্ণ করে তেজস্বী তাপস

দীপ্তির কৃপাণে;

বীরের দক্ষিণ হস্ত মুক্তিমন্ত্রে বজ্র করে বশ,

অসত্যেরে হানে।

হে অভিসারিকা, তব বহুদূর পদধ্বনি লাগি

আপনার মনে

বাণীহীন প্রতীক্ষায় আমি আজ একা বসে জাগি

নির্জন প্রাঙ্গণে।

দীপ চাহে তব শিখা, মৌনী বীণা ধেয়ায় তোমার

অঙ্গুলিপরশ।

তারায় তারায় খোঁজে তৃষ্ণায়-আতুর অন্ধকার

সঙ্গসুধারস।

নিদ্রাহীন বেদনায় ভাবি কবে আসিবে পরানে

চরম আহ্বান।

মনে জানি এ জীবনে সাঙ্গ হয় নাই পূর্ণ তানে

মোর শেষ গান।

কোথা তুমি, শেষবার যে ছোঁয়াবে তব স্পর্শমণি

আমার সংগীতে।

মহানিস্তব্ধের প্রান্তে কোথা বসে রয়েছ রমণী

নীরব নিশীথে।

মহেন্দ্রের বজ্র হতে কালো চক্ষে বিদ্যুতের আলো

আনো আনো ডাকি--

বর্ষণ-কাঙাল মোর মেঘের অন্তরে বহ্নি জ্বালো

হে কালবৈশাখী।

অশ্রুভারে ক্লান্ত তার স্তব্ধ মূক অবরুদ্ধ দান

কালো হয়ে উঠে।

বন্যাবেগে মুক্ত করো, রিক্ত করি করো পরিত্রাণ,

সব লও লুটে।

তার পরে যাও যদি যেয়ো চলি, দিগন্ত-অঙ্গন

হয়ে যাবে স্থির।

বিরহের শুভ্রতায় শূন্যে দেখা দিবে চিরন্তন

শান্তি সুগম্ভীর।

স্বচ্ছ আনন্দের মাঝে মিলে যাবে সর্বশেষ লাভ,

সর্বশেষ ক্ষতি--

দুঃখে সুখে পূর্ণ হবে অরূপসুন্দর আবির্ভাব,

অশ্রুধৌত জ্যোতি।

ওরে পান্থ, কোথা তোর দিনান্তের যাত্রাসহচরী।

দক্ষিণপবন

বহুক্ষণ চলে গেছে অরণ্যের পল্লব মর্মরি--

নিকুঞ্জভবন

গন্ধের ইঙ্গিত দিয়ে বসন্তের উৎসবের পথ

করে না প্রচার।

কাহারে ডাকিস তুই, গেছে চলে তার স্বর্ণরথ

কোন্‌ সিন্ধুপার।

জানি জানি, আপনার অন্তরের গহনবাসীরে

আজিও না চিনি।

সন্ধ্যারতিলগ্নে কেন আসিলে না নিভৃত মন্দিরে

শেষ পূজারিনী।

কেন সাজালে না দীপ, তোমার পূজার মন্ত্র-গানে

জাগায়ে দিলে না

তিমিররাত্রির বাণী, গোপনে যা লীন আছে প্রাণে

দিনের অচেনা।

অসমাপ্ত পরিচয় অসম্পূর্ণ নৈবেদ্যের থালি

নিতে হল তুলে।

রচিয়া রাখে নি মোর প্রেয়সী কি বরণের ডালি

মরণের কূলে।

সেখানে কি পুষ্পবনে গীতহীনা রজনীর তারা

নব জন্ম লভি

এই নীরবের বক্ষে নব ছন্দে ছুটাবে ফোয়ারা

প্রভাতী ভৈরবী।