আলোকের আভা তার অলকের চুলে,

বুকের কাছেতে হাঁটু তুলে

বসে আছে ঠেস দিয়ে পিপুলগুঁড়িতে,

পাশেই পাহাড়ে নদী নুড়িতে নুড়িতে

ফুলে উঠে চলে যায় বেগে।

দেবদারু-ছায়াতলে উঠে জেগে

কলস্বর,

কান পেতে শোনে তাই প্রাচীন পাথর--

অরণ্যের কোল

যেন মুখরিয়া তোলে শিশুর কল্লোল।

ইংরেজ কবির লেখা একমনে পড়িছে তরুণী,

গুন্‌গুন্‌ রব তার পিছনে দাঁড়ায়ে আমি শুনি;

মৃদু বেদনায় ভাবি, যে-কবির বাণী

পড়িছে বিরাম নাহি মানি,

আমি কেন সে কবি না হই।

এতদিন নানাভাবে কাব্যে যাহা কই

আজি এ গিরির মতো কেন সে নির্বাক।

অদূরে মাদার-শাখে ঘুঘু দেয় ডাক।

আমার মর্মের ছন্দ পাখির ভাষায়

অফুরান নৈরাশায়

উছলিতে থাকে একতানে

আন-মননীর কানে কানে।

আতপ্ত হতেছে দিন, শিশির শুকায়ে গেছে ঘাসে,

অজানা ফুলের গুচ্ছ উচ্চ শাখে দুলিছে বাতাসে।

ঢালু তটে তরুচ্ছায়াতলে

ঝিলিমিলি শিহরন ঝরনার জলে।

চূর্ণ কেশে নিত্য চঞ্চলতা,

দুর্বাধ্য পড়িছে চোখে, অধ্যয়নরতা

সরায়ে দিতেছে বারংবার

বাহুক্ষেপে। ধৈর্য মোর রহিল না আর;

চকিতে সম্মুখে আসি শুধালাম,

"তুমি কি শোন নি মোর নাম।"

মুখে তার সে কি অসন্তোষ,

সে কি লজ্জা, সে কি রোষ,

সে কি সমুদ্ধত অহংকার।

উত্তর শোনার

অপেক্ষা না করি আমি দ্রুত গেনু চলি।

ঘুঘুর কাকলি

ঘন পল্লবের মাঝে আশ্বিনের রৌদ্র ও ছায়ারে

ব্যথিত করিছে চির নিরুত্তর ব্যর্থতার ভারে।

মিথ্যা, মিথ্যা এ স্বপন, ঘরে ফিরে বসিয়া নির্জনে

শৈল-অরণ্যের সেই ছবিখানি আনি মনে-মনে

অসম্ভব রচনায়

পূরণ করিনু তারে ঘটে নি যা সেই কল্পনায়।

যদি সত্য হ'ত, যদি বলিতাম কিছু,

শুনিত সে মাথা করি নিচু,

কিংবা যদি সুতীব্র চাহনি

বিদ্যুৎবাহনী

কটাক্ষে হানিত মুখে

রক্ত মোর আলোড়িয়া বুকে,

কিংবা যদি চলে যেত অঞ্চল সংবরি

শুষ্কপত্রপরিকীর্ণ বনপথ সচকিত করি,

আমি রহিতাম চেয়ে

হেসে উঠিতাম গেয়ে,--

"চলে গেলে হে রূপসী, মুখখানি ঢেকে,

বঞ্চিত কর নি মোরে, পিছনে গিয়েছ কিছু রেখে।"

হায় রে, হয় নি কিছু বলা,

হয় নি ছায়ার পথে ছায়াসম চলা,

হয়তো সে শিলাতল-'পরে

এখনো পড়িছে কাব্য গুন্‌গুন্‌ স্বরে।