কল্যাণীয়া শ্রীমতী রানী মহলানবীশ

ইটকাঠে গড়া নীরস খাঁচার থেকে

আকাশবিলাসী চিত্তেরে মোর এনেছিলে তুমি ডেকে

শ্যামল শুশ্রুষায়,

নারিকেলবন-পবন-বীজিত নিকুঞ্জ-আঙিনায়।

শরৎ-লক্ষ্মী কনকমাল্যে জড়ায় মেঘের বেণী,

নীলাম্বরের পটে আঁকে ছবি সুপারি গাছের শ্রেণী।

দক্ষিণ ধারে পুকুরের ঘাট বাঁকা সে কোমর-ভাঙা,

লিলি গাছ দিয়ে ঢাকা তার ঢালু ডাঙা।

জামরুল গাছে ধরে অজস্র ফুল,

হরণ করেছে সুরবালিকার হাজার কানের দুল।

লতানে যুথীর বিতানে মৌমাছিরা

করিতেছে ঘুরা-ফিরা।

পুকুরের তটে তটে

মধুচ্ছন্দা রজনীগন্ধা সুগন্ধ তার রটে।

ম্যাগ্‌নোলিয়ার শিথিল পাপড়ি খসে খসে পড়ে ঘাসে,

ঘরের পিছন হতে বাতাবির ফুলের খবর আসে।

একসার মোটা পায়াভারী পাম উদ্ধত মাথা-তোলা,

রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েছে যেন বিলিতি পাহারা-ওলা।

বসি যবে বাতায়নে

কলমি শাকের পাড় দেখা যায় পুকুরের এক কোণে।

বিকেল বেলার আলো

জলে রেখা কাটে সবুজ সোনালি কালো।

ঝিলিমিলি করে আলোছায়া চুপে চুপে

চলতি হাওয়ার পায়ের চিহ্নরূপে।

জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে

আমের শাখায় আঁখি ধেয়ে যায় সোনার রসের আশে।

লিচু ভরে যায় ফলে,

বাদুড়ের সাথে দিনে আর রাতে অতিথির ভাগ চলে।

বেড়ার ওপারে মৈসুমি ফুলে রঙের স্বপ্ন বোনা,

চেয়ে দেখে দেখে জানালার নাম রেখেছি-- "নেত্রকোণা'।

ওরাওঁ জাতের মালী ও মালিনী ভোর হতে লেগে আছে_

মাটি খোঁড়াখুঁড়ি, জল ঢালাঢালি গাছে।

মাটিগড়া যেন নিটোল অঙ্গ, মাটির নাড়ীর টানে

গাছপালাদের স্বজাত বলেই জানে।

রাত পোহালেই পাড়ার গোয়ালা গাভীদুটি নিয়ে আসে,

অধীর বাছুর ছুটোছুটি করে পাশে।

সাড়ে ছ'টা বাজে, সোজা হয়ে রোদ চলে আসে মোর ঘরে,

পথে দেখা দেয় খবরওয়ালা বাইক-রথের 'পরে।

পাঁচিল পেরিয়ে পুরোনো দোতলা বাড়ি,

আলসের ধারে এলোকেশিনীরা ঝোলায় সিক্ত শাড়ি।

পাড়ার মেয়েরা জল নিতে আসে ঘাটে,

সবুজ গহনে দু-চোখ ডুবিয়ে সোনার সকাল কাটে,

বাংলাদেশের বনপ্রকৃতির মন

শহর এড়িয়ে রচিল এখানে ছায়া দিয়ে ঘেরা কোণ।

বাংলাদেশের গৃহিণী তাহার সাথে

আপন স্নিগ্ধ হাতে

সেবার অর্ঘ্য করেছে রচনা নীরব-প্রণতি-ভরা,

তারি আনন্দ কবিতায় দিল ধরা।

শুনেছি এবার হেথায় তোমার কদিনের ঘরবাড়ি

চলে যাবে তুমি ছাড়ি।

মেঘরৌদ্রের খেলার সৃষ্টি ওই পুকুরের ধারে

লজ্জিত হবে অকবি ধনীর দৃষ্টির অধিকারে।

কালের লীলায় দিয়ে যাব সায়, খেদ রাখিব না চিতে--

এ ছবিখানি তো মন হতে ধনী পারিবে না কেড়ে নিতে।

তোমার বাগানে দেখেছি তোমারে কাননলক্ষ্মীসম--

তাহারি স্মরণ মম

শীতের রৌদ্রে, মুখর বর্ষারাতে

কুলায়বিহীন পাখির মতন

মিলিবে মেঘের সাথে।