উজ্জ্বল শ্যামল বর্ণ, গলায় পলার হারখানি।

চেয়েছি অবাক মানি

তার পানে।

বড়ো বড়ো কাজল নয়ানে

অসংকোচে ছিল চেয়ে

নবকৈশোরের মেয়ে,

ছিল তারি কাছাকাছি বয়স আমার।

স্পষ্ট মনে পড়ে ছবি। ঘরের দক্ষিণে খোলা দ্বার,

সকালবেলার রোদে বাদামগাছের মাথা

ফিকে আকাশের নীলে মেলেছে চিকন ঘন পাতা।

একখানি সাদা শাড়ি কাঁচা কচি গায়ে,

কালো পাড় দেহ ঘিরে ঘুরিয়া পড়েছে তার পায়ে।

দুখানি সোনার চুড়ি নিটোল দু হাতে,

ছুটির মধ্যাহ্নে পড়া কাহিনীর পাতে

ওই মূর্তিখানি ছিল। ডেকেছে সে মোরে মাঝে মাঝে

বিধির খেয়াল যেথা নানাবিধ সাজে

রচে মরীচিকালোক নাগালের পারে

বালকের স্বপ্নের কিনারে।

দেহ ধরি মায়া

আমার শরীরে মনে ফেলিল অদৃশ্য ছায়া

সূক্ষ্ণ স্পর্শময়ী।

সাহস হল না কথা কই।

হৃদয় ব্যথিল মোর অতিমৃদু গুঞ্জরিত সুরে--

ও যে দূরে, ও যে বহুদূরে,

যত দূরে শিরীষের ঊর্ধ্বশাখা যেথা হতে ধীরে

ক্ষীণ গন্ধ নেমে আসে প্রাণের গভীরে।

একদিন পুতুলের বিয়ে,

পত্র গেল দিয়ে।

কলরব করেছিল হেসে খেলে

নিমন্ত্রিত দল। আমি মুখচোরা ছেলে

একপাশে সংকোচে পীড়িত। সন্ধ্যা গেল বৃথা,

পরিবেশনের ভাগে পেয়েছিনু মনে নেই কী তা।

দেখেছিনু, দ্রুতগতি দুখানি পা আসে যায় ফিরে,

কালো পাড় নাচে তারে ঘিরে।

কটাক্ষে দেখেছি, তার কাঁকনে নিরেট রোদ

দু হাতে পড়েছে যেন বাঁধা। অনুরোধ উপরোধ

শুনেছিনু তার স্নিগ্ধ স্বরে।

ফিরে এসে ঘরে

মনে বেজেছিল তারি প্রতিধ্বনি

অর্ধেক রজনী।

তার পরে একদিন

জানাশোনা হল বাধাহীন।

একদিন নিয়ে তার ডাকনাম

তারে ডাকিলাম।

একদিন ঘুচে গেল ভয়,

পরিহাসে পরিহাসে হল দোঁহে কথা-বিনিময়।

কখনো বা গড়ে-তোলা দোষ

ঘটায়েছে ছল-করা রোষ।

কখনো বা শ্লেষবাক্যে নিষ্ঠুর কৌতুক

হেনেছিল দুখ।

কখনো বা দিয়েছিল অপবাদ

অনবধানের অপরাধ।

কখনো দেখেছি তার অযত্নের সাজ--

রন্ধনে ছিল সে ব্যস্ত, পায় নাই লাজ।

পুরুষসুলভ মোর কত মূঢ়তারে

ধিক্‌কার দিয়েছে নিজ স্ত্রীবুদ্ধির তীব্র অহংকারে।

একদিন বলেছিল, "জানি হাত দেখা।"

হাতে তুলে নিয়ে হাত নতশিরে গণেছিল রেখা--

বলেছিল, "তোমার স্বভাব

প্রেমের লক্ষণে দীন।" দিই নাই কোনোই জবাব।

পরশের সত্য পুরস্কার

খণ্ডিয়া দিয়েছে দোষ মিথ্যা সে নিন্দার।

তবু ঘুচিল না

অসম্পূর্ণ চেনার বেদনা।

সুন্দরের দূরত্বের কখনো হয় না ক্ষয়,

কাছে পেয়ে না পাওয়ার দেয় অফুরন্ত পরিচয়।

পুলকে বিষাদে মেশা দিন পরে দিন

পশ্চিমে দিগন্তে হয় লীন।

চৈত্রের আকাশতলে নীলিমার লাবণ্য ঘনাল,

আশ্বিনের আলো

বাজাল সোনার ধানে ছুটির সানাই।

চলেছে মন্থর তরী নিরুদ্দেশে স্বপ্নেতে বোঝাই।