জানালা খুলিতেই স্তব্ধ রাত্রি অনন্ত তীর্থপথের পথিকের মতো রোগীর দরজার কাছে চুপ করিয়া দাঁড়াইল । কত যুগের কত মৃত্যুকালের সাক্ষী ঐ তারাগুলি যতীনের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল ।
যতীন এই বৃহৎ অন্ধকারের পটের উপর তাহার মণির মুখখানি দেখিতে পাইল । সেই মুখের ডাগর দুটি চক্ষু মোটা মোটা জলের ফোঁটার ভরা-- সে জল যেন আর শেষ হইল না, চিরকালের জন্য ভরিয়া রহিল ।
অনেকক্ষণ সে চুপ করিয়া আছে দেখিয়া মাসি নিশ্চিত হইলেন । ভাবিলেন, যতীনের ঘুম আসিয়াছে ।
এমন সময় হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল,'মাসি,তোমরা কিন্তু বারবার মনে করে এসেছ,মণির মন চঞ্চল,আমাদের ঘরে ওর মন বসে নি । কিন্তু দেখো--'
'না,বাবা,ভুল বুঝেছিলুম -- সময় হলেই মানুষকে চেনা যায় !'
'মাসি !''
'যতীন,ঘুমোও,বাবা ।'
'আমাকে একটু ভাবতে দাও, একটু কথা কইতে দাও ! বিরক্ত হোয়ো না মাসি ।'
'আচ্ছা, বলো,বাবা ।'
'আমি বলছিলুম, মানুষের নিজের মন নিজে বুঝতে কত সময় লাগে ! একদিন যখন মনে করতুম ,আমরা কেউ মণির মন পেলুম না, তখন চুপ করে সহ্য করেছি । তোমরা তখন--'
'না, বাবা,অমন কথা বোলো না-- আমিও সহ্য করেছি ।'
'মন তো মাটির ঢেলা নয়,কুড়িয়ে নিলেই তো নেওয়া যায় না । আমি জানতুম, মণি নিজের মন এখনো বোঝে নি; কোনো একটা আঘাতে যেদিন বুঝবে সেদিন আর--'
'ঠিক কথা, যতীন ।'
'সেইজন্যই ওর ছেলেমানুষিতে কোনোদিন কিছু মনে করি নি ।'
মাসি এ কথার কোনো উত্তর করিলেন না; কেবল মনে মনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন ।
কতদিন তিনি লক্ষ্য করিয়াছেন,যতীন বারান্দায় আসিয়া রাত কাটাইয়াছে, বৃষ্টির ছাট আসিয়াছে তবু ঘরে যায় নাই । কতদিন সে মাথা ধরিয়া বিছানায় পড়িয়া ; একান্ত ইচ্ছা,মণি আসিয়া মাথায় একটু হাত বুলাইয়া দেয় । মণি তখন সখীদের সঙ্গে দল বাঁধিয়া থিয়েটার দেখিতে যাইবার আয়োজন করিতেছে । তিনি যতীনকে পাখা করিতে আসিয়াছেন, সে বিরক্ত হইয়া তাঁহাকে ফিরাইয়া দিয়াছে । সেই বিরক্তির মধ্যে কত বেদনা তাহা জানিতেন। কতবার তিনি যতীনকে বলিতে চাহিয়াছেন, বাবা , তুমি ঐ মেয়েটার দিকে অত বেশি মন দিয়ো না -- ও একটু চাহিতে শিখুক -- মানুষকে একটু কাঁদানো চাই ।'কিন্তু এ-সব কথা বলিবার নহে,বলিলেও কেহ বোঝে না । যতীনের মনে নারীদেবতার একটি পীঠস্থান ছিল, সেইখানে সে মণিকে বসাইয়াছে । সেই তীর্থক্ষেত্রে নারীর অমৃতপাত্র চিরদিন তাহার ভাগ্যে শূন্য থাকিতে পারে,এ কথা মনে করা তাহার পক্ষে সহজ ছিল না । তাই পূজা চলিতেছিল,অর্ঘ্য ভরিয়া উঠিতেছিল, বরলাভের আশা পরাভব মানিতেছিল না ।
মাসি যখন আবার ভাবিতেছিলেন যতীন ঘুমাইয়াছে, এমন সময়ে হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল, 'আমি জানি, তুমি মনে করেছিলে, মণিকে নিয়ে আমি সুখী হতে পারি নি । তাই তার উপর রাগ করতে। কিন্তু, মাসি, সুখ জিনিসটা ঐ তারাগুলির মতো, সমস্ত অন্ধকার লেপে রাখে না, মাঝে মাঝে ফাঁক থেকে যায় । জীবনে কত ভুল করি, কত ভূল বুঝি, তবু তার ফাঁকে ফাঁকে কি স্বর্গের আলো জ্বলে নি । কোথা থেকে আমার মনের ভিতরটি আজ এমন আনন্দে ভরে উঠেছে ।'
মাসি আস্তে আস্তে যতীনের কপালে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন । অন্ধকারে তাঁহার দুই চক্ষু বাহিয়া যে জল পড়িতেছিল তাহা কেহ দেখিতে পাইল না ।
'আমি ভাবছি, মাসি,ওর অল্প বয়স,ও কী নিয়ে থাকবে ।'
'অল্প বয়স কিসের , যতীন ? এ তো ওর ঠিক বয়স । আমরাও তো, বাছা, অল্প বয়সেই দেবতাকে সংসারের দিকে ভাসিয়ে অন্তরের মধ্যে বসিয়েছি-- তাতে ক্ষতি হয়েছে কী । তাও বলি সুখেরই বা এত বেশি দরকার কিসের !'
'মাসি,মণির মনটি যেই জাগবার সময় হল অমনি আমি--'
'ভাব কেন যতীন ? মন যদি জাগে তবে সেই কি কম ভাগ্য !'
হঠাৎ অনেক দিনের শোনা একটা বাউলের গান যতীনের মনে পড়িয়া গেল--
ওরে মন, যখন জাগলি না রে
তখন মনের মানুষ এল দ্বারে ।
তার চলে যাবার শব্দ শুনে
ভাঙল রে ঘুম,
ও তোর ভাঙল রে ঘুম অন্ধকারে ॥
'মাসি,ঘড়িতে ক'টা বেজেছে ।'
'ন'টা বাজবে ।'
'সবে ন'টা ? আমি ভাবছিলুম, বুঝি দুটো, তিনটে, কি ক'টা হবে । সন্ধ্যার পর থেকেই আমার দুপুর রাত আরম্ভ হয় । তবে তুমি আমার ঘুমের জন্যে অত ব্যস্ত হয়েছিলে কেন ।'
'কালও সন্ধ্যার পর এইরকম কথা কইতে কইতে কত রাত পর্যন্ত তোমার আর ঘুম এল না ,তাই আজ তোমাকে সকাল-সকাল ঘুমোতে বলছি ।'
'মণি কি ঘুমিয়েছে ।'
'না,সে তোমার জন্যে মসুরির ডালের সুপ তৈরি ক'রে তবে ঘুমোতে যায়।'
'বলো কী, মাসি, মণি কি তবে--'
'সেই তো তোমার জন্যে সব পথ্যি তৈরি করে দেয়। তার কি বিশ্রাম আছে ।'
'আমি ভাবতুম ,মণি বুঝি --'
'মেয়েমানুষের কি আর এ-সব শিখতে হয় । দায়ে পড়লেই আপনি করে নেয় ।''
'আজ দুপুরবেলা মৌরলা মাছের যে ঝোল হয়েছিল তাতে বড়ো সুন্দর একটি তার ছিল । আমি ভাবছিলুম,তোমারই হাতের তৈরি ।'
'কপাল আমার ! মণি কি আমাকে কিছু করতে দেয় । তোমার গামছা তোয়ালে নিজের হাতে কেচে শুকিয়ে রাখে । জানে যে,কোথাও কিছু নোংরা তুমি দেখতে পার না । তোমার বাইরের বৈঠকখানা যদি ঐকবার দেখ তবে দেখতে পাবে, মণি দুবেলা সমস্ত ঝেড়ে মুছে কেমন তক্তক্ ক'রে রেখে দিয়েছে ; আমি যদি তোমার এ ঘরে ওকে সর্বদা আসতে দিতুম তা হলে কি আর রক্ষা থাকত ! ও তো তাই চায় ।'
'মণির শরীরটা বুঝি --'
'ডাক্তাররা বলে রোগীর ঘরে ওকে সর্বদা অনাগোনা করতে দেওয়া কিছু নয় । ওর মন বড়ো নরম কি না, তোমার কষ্ট দেখলে দুদিনে যে শরীর ভেঙে পড়বে ।'
'মাসি,ওকে তুমি ঠেকিয়ে রাখ কী করে ।'
'আমাকে ও বড্ডো মানে বলেই পারি । তবু বার বার গিয়ে খবর দিয়ে আসতে হয় -- ঐ আমার আর-এক কাজ হয়েছে ।'
আকাশের তারাগুলি যেন করুণা-বিগলিত চোখের জলের মতো জ্বল্জ্বল্ করিতে লাগিল । যে জীবন আজ বিদায় লইবার পথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে যতীন তাহাকে মনে মনে কৃতজ্ঞতার প্রণাম করিল-- এবং সম্মুখে মৃত্যু আসিয়া অন্ধকারের ভিতর হইতে যে দক্ষিণ হাত বাড়াইয়া দিয়াছে যতীন স্নিগ্ধ বিশ্বাসের সহিত তাহার উপরে আপনার রোগক্লান্ত হাতটি রাখিল ।
একবার নিশ্বাস ফেলিয়া, একটুখানি উস্খুস্ করিয়া যতীন বলিল ,'মাসি,মণি যদি জেগেই থাকে তা হলে একবার যদি তাকে--'
'এখনি ডেকে দিচ্ছি , বাবা ।'
'আমি বেশিক্ষণ তাকে এ ঘরে রাখতে চাই নে-- কেবল পাঁচ মিনিট-- দুটো একটা কথা যা বলবার আছে--'
মাসি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মণিকে ডাকিতে আসিলেন । এদিকে যতীনের নাড়ী দ্রুত চলিতে লাগিল । যতীন জানে, আজ পর্যন্ত সে মণির সঙ্গে ভালো করিয়া কথা জমাইতে পারে নাই । দুই যন্ত্র সুরে বাঁধা ,একসঙ্গে আলাপ চলা বড়ো কঠিন । মণি তাহার সঙ্গিনীদের সঙ্গে অনর্গল বকিতেছে হাসিতেছে,দূর হইতে তাহাই শুনিয়া যতীনের মন কতবার ঈর্ষায় পীড়িত হইয়াছে । যতীন নিজেকেই দোষ দিয়াছে-- সে কেন অমন সামান্য যাহা-তাহা লইয়া কথা কহিতে পারে না । পারে না যে তাহাও তো নহে,নিজের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যতীন সামান্য বিষয় লইয়াই কি আলাপ করে না । কিন্তু পুরুষের যাহা-তাহা তো মেয়েদের যাহা-তাহার সঙ্গে ঠিক মেলে না । বড়ো কথা একলাই একটানা বলিয়া যাওয়া চলে, অন্য পক্ষ মন দিল কি না খেয়াল না করিলেই হয়, কিন্তু তুচ্ছ কথায় নিয়ত দুই পক্ষের যোগ থাকা চাই ; বাঁশি একাই বাজিতে পারে,কিন্তু দুইয়ের মিল না থাকিলে করতালের খচমচ জমে না । এইজন্যে কত সন্ধ্যাবেলায় যতীন মণির সঙ্গে যখন খোলা বারান্দায় মাদুর পাতিয়া বসিয়াছে, দুটো-চারটে টানাবোনা কথার পরেই কথার সূত্র একেবারে ছিঁড়িয়া ফাঁক হইয়া গেছে ; তাহার পরে সন্ধ্যার নীরবতা যেন লজ্জায় মরিতে চাহিয়াছে । যতীন বুঝিতে পারিয়াছে, মণি পালাইতে পারিলে বাঁচে; মনে মনে কামনা করিয়াছে, এখনই কোনো একজন তৃতীয় ব্যক্তি যেন আসিয়া পড়ে। কেননা,দুই জনে কথা কহা কঠিন, তিন জনে সহজ ।
মণি আসিলে আজ কেমন করিয়া কথা আরম্ভ করিবে, যতীন তাহাই ভাবিতে লাগিল । ভাবিতে গেলে কথাগুলো কেমন অস্বাভাবিক রকম বড়ো হইয়া পড়ে-- সে-সব কথা চলিবে না । যতীনের আশঙ্কা হইতে লাগিল, আজকের রাত্রের পাঁচ মিনিটও ব্যর্থ হইবে । অথচ,তাহার জীবনে এমনতরো নিরালা পাঁচ মিনিট আর ক'টাই বা বাকি আছে ।