এ-দিকে ডেস্কে-বাঁধা স্থাবরত্বের চাপে দেখতে দেখতে আমার যৌবনের ধারা আসছে ভোঁতা হয়ে। অন্য-কোনো পুরুষ হলে সে কথাটা নিশ্চিন্ত মনে ভুলে গিয়ে পেটের পরিধিবিস্তারকে দুর্বিপাক বলে গণ্য করত না। আমি তা পারি নে। আমি জানি, সুনেত্রা মুগ্ধ হয়েছিল শুধু আমার গুণে নয়, আমার দেহসৌষ্ঠবে। বিধাতার স্বরচিতে যে-বরমাল্য অঙ্গে নিয়ে একদিন তাকে বরণ করেছি নিশ্চিত তার প্রয়োজন আছে প্রতিদিনের অভ্যর্থনায়। আশ্চর্য এই যে, সুনেত্রার যৌবন আজও রইল অক্ষুণ্ন, দেখতে দেখতে আমিই চলেছি ভাঁটার মুখে-- শুধু ব্যাঙ্কে জমছে টাকা।
আমাদের মিলনের প্রথম অভ্যুদয়কে আর-একবার প্রত্যক্ষ চোখের সামনে আনল আমার মেয়ে অরুণা। আমাদের জীবনের সেই উষারুণরাগ দেখা দিয়েছে ওদের তারুণ্যের নবপ্রভাতে। দেখে পুলকিত হয়ে ওঠে আমার সমস্ত মন। শৈলেনের দিকে চেয়ে দেখি, আমার সেদিনকার বয়স ওর দেহে আবির্ভূত। যৌবনের সেই ক্ষিপ্তশক্তি, সেই অজস্র প্রফুল্লতা, আবার ক্ষণে ক্ষণে প্রতিহত দুরাশায় ম্লায়মান উৎসাহের উৎকণ্ঠা। সেই দিন আমি যে-পথে চলতেম সেই পথ ওরও সামনে, তেমনি করেই অরুণার মায়ের মন বশ করবার নানা উপলক্ষ্য ও সৃষ্টি করছে, কেবল যথেষ্ট লক্ষ্যগোচর নই আমিই। অপর পক্ষে অরুণা জানে মনে মনে, তার বাবা বোঝে মেয়ের দরদ। এক-একদিন কী জানি কেন দুই চক্ষে অদৃশ্য অশ্রুর করুণা নিয়ে চুপ করে এসে বসে আমার পায়ের কাছের মোড়ায়। ওর মা নিষ্ঠুর হতে পারে, আমি পারি নে।
অরুণার মনের কথা ওর মা যে বোঝে না তা নয়; কিন্তু তার বিশ্বাস, এ সমস্তই 'প্রভাতে মেঘডম্বরম্', বেলা হলেই যাবে মিলিয়ে। ঐখানেই সুনেত্রার সঙ্গে আমার মতের অনৈক্য। খিদে মিটতে না দিয়ে খিদে মেরে দেওয়া যায় না তা নয়, কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন পাত পড়বে তখন হৃদয়ের রসনায় নবীন ভালোবাসার স্বাদ যাবে মরে। মধ্যাহ্নে ভোরের সুর লাগাতে গেলে আর লাগে না। অভিভাবক বলেন, বিবেচনা করবার বয়েস হোক আগে, তার পরে ইত্যাদি। হায় রে, বিবেচনা করবার বয়েস ভালোবাসার বয়েসের উলটোপিঠে।
কয়েকদিন আগেই এসেছিল 'ভরা বাদর মাহ ভাদর'। ঘনবর্ষণের আড়ালে কলকাতার ইটকাঠের বাড়িগুলো এল মোলায়েম হয়ে, শহরের প্রখর মুখরতা অশ্রুগদ্গদ কণ্ঠস্বরের মতো হল বাষ্পাকুল। ওর মা জানত অরুণা আমার লাইব্রেরি-ঘরে পরীক্ষার পড়ায় প্রবৃত্ত। একখানা বই আনতে গিয়ে দেখি, মেঘাচ্ছন্ন দিনান্তের সজল ছায়ায় জানলার সামনে সে চুপ করে বসে, তখনো চুল বাঁধে নি, পুবে হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে তার এলোচুলে।
সুনেত্রাকে কিছু বললেম না। তখনি শৈলেনকে লিখে দিলেম চায়ের নিমন্ত্রণ-চিঠি। পাঠিয়ে দিলেম আমার মোটরগাড়ি ওদের বাড়িতে। শৈলেন এল, তার অকস্মাৎ আবির্ভাব সুনেত্রার পছন্দ নয়, সেটা বোঝা কঠিন ছিল না। আমি শৈলেনকে বললেম, 'গণিতে আমার যেটুকু দখল তাতে হাল আমলের ফিজিক্সের তল পাই নে, তাই তোমাকে ডেকে পাঠানো; কোয়ান্টম্ থিয়োরিটা যথাসাধ্য বুঝে নিতে চাই, আমার সেকেলে বিদ্যেসাধ্যি অত্যন্ত বেশি অথর্ব হয়ে পড়েছে।'
বলা বাহুল্য, বিদ্যাচর্চা বেশিদূর এগোয় নি। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস অরুণা তার বাবার চাতুরি স্পষ্টই ধরেছে আর মনে মনে বলেছে, এমন আদর্শ বাবা অন্য-কোনো পরিবারে আজ পর্যন্ত অবতীর্ণ হয় নি।
কোয়ান্টম্ থিয়োরির ঠিক শুরুতেই বাজল টেলিফোনের ঘন্টা-- ধড়ফড়িয়ে উঠে বললেম, 'জরুরি কাজের ডাক। তোমরা এক কাজ করো, ততক্ষণ পার্লার টেনিস খেলো, ছুটি পেলেই আবার আসব ফিরে।'
টেলিফোনে আওয়াজ এল, 'হ্যালো, এটা কি বারোশো অমুক নম্বর।'
আমি বললেম, 'না, এখানকার নম্বর সাতশো অমুক।'
পরক্ষণেই নিচের ঘরে গিয়ে একখানা বাসি খবরের কাগজ তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলেম, অন্ধকার হয়ে এল, দিলেম বাতি জ্বেলে।
সুনেত্রা এল ঘরে। অত্যন্ত গম্ভীর মুখ। আমি হেসে বললেম, 'মিটিয়রলজিস্ট্ তোমার মুখ দেখলে ঝড়ের সিগনাল দিত।'
ঠাট্টায় যোগ না দিয়ে সুনেত্রা বললে, 'কেন তুমি শৈলেনকে অমন করে প্রশ্রয় দাও বারে বারে।'
আমি বললেম, 'প্রশ্রয় দেবার লোক অদৃশ্যে আছে ওর অন্তরাত্মায়।'
'ওদের দেখাশোনাটা কিছুদিন বন্ধ রাখতে পারলে এই ছেলেমানুষিটা কেটে যেত আপনা হতেই।'
'ছেলেমানুষির কসাইগিরি করতে যাবই বা কেন। দিন যাবে, বয়স বাড়বে, এমন ছেলেমানুষি আর তো ফিরে পাবে না কোনোকালে।'
'তুমি গ্রহনক্ষত্র মান' না, আমি মানি। ওরা মিলতে পারে না।'
'গ্রহনক্ষত্র কোথায় কী ভাবে মিলেছে চোখে পড়ে না, কিন্তু ওরা দুজনে যে মিলেছে অন্তরে অন্তরে সেটা দেখা যাচ্ছে খুব স্পষ্ট করেই।'
'তুমি বুঝবে না আমার কথা। যখনি আমরা জন্মাই তখনি আমাদের যথার্থ দোসর ঠিক হয়ে থাকে। মোহের ছলনায় আর-কাউকে যদি স্বীকার করে নিই তবে তাতেই ঘটে অজ্ঞাত অসতীত্ব। নানা দুঃখে বিপদে তার শাস্তি।'
'যথার্থ দোসর চিনব কী করে।'
'নক্ষত্রের স্বহস্তে স্বাক্ষর-করা দলিল আছে।'