হাওয়ার বেগ বাড়তে চলল, বৃষ্টির বিরাম নেই। সুনেত্রাকে বললেম, 'আলোটা লাগছে চোখে, নিবিয়ে দিই।' নিবিয়ে দিলেম।

বৃষ্টিধারার মধ্যে দিয়ে রাস্তার ল্যাম্পের ঝাপসা আভা এল অন্ধকার ঘরে। সোফার উপরে সুনেত্রাকে বসালেম আমার পাশে। বললেম, 'সুনি, আমাকে তোমার যথার্থ দোসর বলে মান তুমি?'

'এ আবার কী প্রশ্ন হল তোমার। উত্তর দিতে হবে নাকি।'

'তোমার গ্রহতারা যদি না মানে?'

'নিশ্চয় মানে, আমি বুঝি জানি নে?'

'এতদিন তো একত্রে কাটল আমাদের, কোনো সংশয় কি কোনোদিন উঠেছে তোমার মনে?'

'অমন সব বাজে কথা জিজ্ঞাসা কর যদি রাগ করব।'

'সুনি, দুজনে মিলে দুঃখ পেয়েছি অনেকবার। আমাদের প্রথম ছেলেটি মারা গেছে আট-মাসে। টাইফয়েডে আমি যখন মরণাপন্ন, বাবার হল মৃত্যু। শেষে দেখি উইল জাল করে দাদা নিয়েছেন সমস্ত সম্পত্তি। আজ চাকরিই আমার একমাত্র ভরসা। তোমার মায়ের স্নেহ ছিল আমার জীবনের ধ্রুবতারা। পুজোর ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার পথে নৌকোডুবি হয়ে স্বামীর সঙ্গে মারা গেলেন মেঘনা নদীর গর্ভে। দেখলেন, বিষয়বুদ্ধিহীন অধ্যাপক ঋণ রেখে গেছেন মোটা অঙ্কের; সেই ঋণ স্বীকার করে নিলেম। কেমন করে জানব, এই সমস্ত বিপত্তি ঘটায় নি আমারই দুষ্টগ্রহ? আগে থাকতে যদি জানতে আমাকে তো বিয়ে করতে না।'

সুনেত্রা কোনো উত্তর না দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলে।

আমি বললেম, 'সব দুঃখ দুর্লক্ষণের চেয়ে ভালোবাসাই যে বড়ো, আমাদের জীবনে তার কী প্রমাণ হয় নি।'

'নিশ্চয়, নিশ্চয় হয়েছে।'

'মনে করো, যদি গ্রহের অনুগ্রহে তোমার আগেই আমার মৃত্যু হয়, সেই ক্ষতি কি বেঁচে থাকতেই আমি পূরণ করতে পারি নি।'

'থাক্‌ থাক্‌, আর বলতে হবে না।'

'সাবিত্রীর কাছে সত্যবানের সঙ্গে একদিনের মিলনও যে চিরবিচ্ছেদের চেয়ে বড়ো ছিল, তিনি তো ভয় করেন নি মৃত্যুগ্রহকে।'

চুপ করে রইল সুনেত্রা। আমি বললেম, 'তোমার অরুণা ভালোবেসেছে শৈলেনকে, এইটুকু জানা যথেষ্ট; বাকি সমস্তই থাক্‌ অজানা, কী বল, সুনি।'

সুনেত্রা কোনো উত্তর করলে না।

'তোমাকে যখন প্রথম ভালোবেসেছিলুম, বাধা পেয়েছি। আমি সংসারে দ্বিতীয়বার সেই নিষ্ঠুর দুঃখ আসতে দেব না কোনো গ্রহেরই মন্ত্রণায়। ওদের দুজনের ঠিকুজির অঙ্ক মিলিয়ে সংশয় ঘটতে দেব না কিছুতেই।'

ঠিক সেই সময়েই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। শৈলেন নেমে চলে যাচ্ছে। সুনেত্রা তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে বললে, 'কী, বাবা শৈলেন। এখুনি তুমি যাচ্ছ না কি?'

শৈলেন ভয়ে ভয়ে বললে, 'কিছু দেরি হয়েই গেছে, ঘড়ি ছিল না, বুঝতে পারি নি।'

সুনেত্রা বললে, 'না, কিছু দেরি হয় নি। আজ রাত্রে তোমাকে এখানেই খেয়ে যেতে হবে।'

একেই তো বলে প্রশ্রয়।

সেই রাত্রে আমার ঠিকুজি সংশোধনের সমস্ত বিবরণ সুনেত্রাকে শোনালাম। সে বলে উঠল, 'না বললেই ভালো করতে।'

'কেন।'

'এখন থেকে কেবলই ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে।'

'কিসের ভয়। বৈধব্যযোগের?'

অনেকক্ষণ চুপ করে রইল সুনি। তার পরে বললে, 'না, করব না ভয়। আমি যদি তোমাকে ফেলে আগে চলে যাই তা হলে আমার মৃত্যু হবে দ্বিগুণ মৃত্যু।'
1 | 2 | 3 | 4