যেদিন হিমাদ্রিশৃঙ্গে নামি আসে আসন্ন আষাঢ়,

মহানদ ব্রহ্মপুত্র আকস্মাৎ দুর্দাম দুর্বার

দুঃসহ অন্তরবেগে তীরতরু করিয়া উন্মূল

মাতিয়া খুঁজিয়া ফিরে আপনার কূল-উপকূল

তট-অরণ্যের তলে তরঙ্গের ডম্বরু বাজায়ে

ক্ষিপ্ত ধূর্জটির প্রায়; সেইমত বনানীর ছায়ে

স্বচ্ছ শীর্ণ ক্ষিপ্রগতি স্রোতস্বতী তমসার তীরে

অপূর্ব উদ্‌বেগভরে সঙ্গীহীন ভ্রমিছেন ফিরে

মহর্ষি বাল্মীকি কবি, রক্তবেগতরঙ্গিত বুকে

গম্ভীর জলদমন্দ্রে বারম্বার আবর্তিয়া মুখে

নব ছন্দ; বেদনায় অন্তর করিয়া বিদারিত

মুহূর্তে নিল যে জন্ম পরিপূর্ণ বাণীর সংগীত,

তারে লয়ে কী করিবে, ভাবে মুনি কী তার উদ্দেশ--

তরুণগরুড়সম কী মহৎক্ষুধার আবেশ

পীড়ন করিছে তারে, কী তাহার দুরন্ত প্রার্থনা,

অমর বিহঙ্গশিশু কোন্‌ বিশ্বে করিবে রচনা

আপন বিরাট নীড়।-- অলৌকিক আনন্দের ভার

বিধাতা যাহারে দেয়, তার বক্ষে বেদনা অপার,

তার নিত্য জাগরণ; অগ্নিসম দেবতার দান

ঊর্ধ্বশিখা জ্বালি চিত্তে আহোরাত্র দগ্ধ করে প্রাণ।

অস্তে গেল দিনমণি। দেবর্ষি নারদ সন্ধ্যাকালে

শাখাসুপ্ত পাখিদের সচকিয়া জটারশ্মিজালে,

স্বর্গের নন্দনগন্ধে অসময়ে শ্রান্ত মধুকরে

বিস্মিত ব্যাকুল করি, উত্তরিলা তপোভূমি-'পরে।

নমস্কার করি কবি শুধাইলা সঁপিয়া আসন--

"কী মহৎ দৈবকার্যে, দেব, তব মর্তে আগমন?"

নারদ কহিলা হাসি, "করুণার উৎসমূখে, মুনি,

যে ছন্দ উঠিল ঊর্ধ্বে, ব্রহ্মলোকে ব্রহ্মা তাহা শুনি

আমারে কহিলা ডাকি, যাও তুমি তমসার তীরে,

বাণীর-বিদ্যুৎ-দীপ্ত ছন্দোবাণ-বিদ্ধ বাল্মীকিরে

বারেক শুধায়ে এসো--বোলো তারে, "ওগো ভাগ্যবান্‌,

এ মহা সংগীতধন কাহারে করিবে তুমি দান।

এই ছন্দে গাঁথি লয়ে কোন্‌ দেবতার যশঃকথা

স্বর্গের অমরে কবি মর্তলোকে দিবে অমরতা?"

কহিলেন শির নাড়ি ভাবোন্মত্ত মহামুনিবর,

"দেবতার সামগীতি গাহিতেছে বিশ্বচরাচর,

ভাষাশূন্য, অর্থাহারা। বহ্নি ঊর্ধ্বে মেলিয়া আঙ্গুলি

ইঙ্গিতে করিছে স্তব; সমুদ্র তরঙ্গবাহু তুলি

কী কহিছে স্বর্গ জানে; অরণ্য উঠায়ে লক্ষ শাখা

মর্মরিছে মহামন্ত্র; ঝটিকা উড়ায়ে রুদ্র পাখা

গাহিছে গর্জনগান; নক্ষত্রের অক্ষৌহিণী হতে

অরণ্যের পতঙ্গ অবধি, মিলাইছে এক স্রোতে

সংগীতের তরঙ্গিণী বৈকুণ্ঠের শান্তিসিন্ধুপারে।

মানুষের ভাষাটুকু অর্থ দিয়ে বদ্ধ চারি ধারে,

ঘুরে মানুষের চতুর্দিকে। অবিরত রাত্রিদিন

মানবের প্রয়োজনে প্রাণ তার হয়ে আসে ক্ষীণ।

পরিস্ফুট তত্ত্ব তার সীমা দেয় ভাবের চরণে;

ধূলি ছাড়ি একেবারে ঊর্ধ্বমুখে অনন্ত গগনে

উড়িতে সে নাহি পারে সংগীতের মতন স্বাধীন

মেলি দিয়া সপ্তসুর সপ্তপক্ষ অর্থভারহীন।

প্রভাতের শুভ্র ভাষা বাক্যহীন প্রত্যক্ষ কিরণ

জগতের মর্মদ্বার মুহূর্তেকে করি উদ্‌ঘাটন।

নির্বারিত করি দেয় ত্রিলোকের গীতের ভাণ্ডার;

যামিনীর শান্তিবাণী ক্ষণমাত্রে অনন্ত সংসার

আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে, বাক্যহীন পরম নিষেধ

বিশ্বকর্মা-কোলাহল মন্ত্রবলে করি দিয়া ভেদ

নিমেষে নিবায়ে দেয় সর্ব খেদ সকল প্রয়াস,

জীবলোক-মাঝে আনে মরণের বিপুল আভাস;

নক্ষত্রের ধ্রুব ভাষা অনির্বাণ অনলের কণা

জ্যোতিষ্কের সূচীপত্রে আপনার করিছে সূচনা

নিত্যকাল মহাকাশে; দক্ষিণের সমীরের ভাষা

কেবল নিশ্বাসমাত্রে নিকুঞ্জে জাগায় নব আশা,

দুর্গম পল্লবদুর্গে অরণ্যের ঘন অন্তঃপুরে

নিমেষে প্রবেশ করে, নিয়ে যায় দূর হতে দূরে

যৌবনের জয়গান-- সেইমত প্রত্যক্ষ প্রকাশ

কোথা মানবের বাক্যে, কোথা সেই অনন্ত আভাস,

কোথা সেই অর্থভেদী অভ্রভেদী সংগীত-উচ্ছ্বাস,

আত্মবিদারণকারী মর্মান্তিক মহান নিশ্বাস?

মানবের জীর্ণ বাক্যে মোর ছন্দ দিবে নব সুর,

অর্থের বন্ধন হতে নিয়ে তারে যাবে কিছু দূর

ভাবের স্বাধীন লোকে, পক্ষবান্‌ অশ্বরাজ-সম

উদ্দাম-সুন্দর-গতি-- সে আশ্বাসে ভাসে চিত্ত মম।

সূর্যেরে বহিয়া যথা ধায় বেগে দিব্য অগ্নিতরী

মহাব্যোমনীলসিন্ধু প্রতিদিন পারাপার করি,

ছন্দ সেই অগ্নিসম বাক্যেরে করিব সমর্পণ--

যাবে চলি মর্তসীমা অবাধে করিয়া সন্তরণ,

গুরুভার পৃথিবীরে টানিয়া লইবে ঊর্ধ্বপানে,

কথারে ভাবের স্বর্গে, মানবেরে দেবপীঠস্থানে।

মহাম্বুধি যেইমত ধ্বনিহীন স্তব্ধ ধরণীরে

বাঁধিয়াছে চতুর্দিকে অন্তহীন নৃত্যগীতে ঘিরে

তেমনি আমার ছন্দ ভাষারে ঘেরিয়া আলিঙ্গনে

গাবে যুগে যুগান্তরে সরল গম্ভীর কলস্বনে

দিক হতে দিগন্তরে মহামানবের স্তবগান,

ক্ষণস্থায়ী নরজন্মে মহৎ মর্যাদা করি দান।

হে দেবর্ষি, দেবদূত, নিবেদিয়ো পিতামহ-পায়ে

স্বর্গ হতে যাহা এল স্বর্গে তাহা নিয়ো না ফিরায়ে।

দেবতার স্তবগীতে দেবেরে মানব করি আনে,

তুলিব দেবতা করি মানুষেরে মোর ছন্দে গানে।

ভগবন্‌, ত্রিভুবন তোমাদের প্রত্যক্ষে বিরাজে--

কহ মোরে কার নাম অমর বীণার ছন্দে বাজে।

কহ মোরে বীর্য কার ক্ষমারে করে না অতিক্রম,

কাহার চরিত্র ঘেরি সুকঠিন ধর্মের নিয়ম

ধরেছে সুন্দর কান্তি মাণিক্যের অঙ্গদের মতো,

মহৈশ্বর্যে আছে নম্র, মহাদৈন্যে কে হয় নি নত,

সম্পদে কে থাকে ভয়ে, বিপদে কে একান্ত নির্ভীক,

কে পেয়েছে সব চেয়ে, কে দিয়েছে তাহার অধিক,

কে লয়েছে নিজশিরে রাজভালে মুকুটের সম

সবিনয়ে সগৌরবে ধরামাঝে দুঃখ মহত্তম--

কহ মোরে, সর্বদর্শী হে দেবর্ষি, তাঁর পুণ্য নাম।"

নারদ কহিলা ধীরে, "অযোধ্যায় রঘুপতি রাম।"

"জানি আমি জানি তাঁরে, শুনেছি তাঁহার কীর্তিকথা"--

কহিলা বাল্মীকি, "তবু, নাহি জানি সমগ্র বারতা,

সকল ঘটনা তাঁর-- ইতিবৃত্ত রচিব কেমনে।

পাছে সত্যভ্রষ্ট হই, এই ভয় জাগে মোর মনে।"

নারদ কহিলা হাসি, "সেই সত্য যা রচিবে তুমি,

ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি

রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।"

এত বলি দেবদূত মিলাইল দিব্য স্বপ্নহেন

সুদূর সপ্তর্ষিলোকে। বাল্মীকি বসিলা ধ্যানাসনে,

তমসা রহিল মৌন, স্তব্ধতা জাগিল তপোবনে।