রোগীর ঘরে দ্বারের কাছে শম্ভু

রোগীর ঘরে দ্বারের কাছে শম্ভু

প্রতিবেশিনীর প্রবেশ

প্রতিবেশিনীর প্রবেশ

প্রতিবেশিনী।

এই যে, শম্ভু।

শম্ভু।

হ্যাঁ, দিদি।

প্রতিবেশিনী।

একবার যতীনকে দেখে যেতে চাই। মাসি নেই, এইবেলা--

শম্ভু।

কী হবে গিয়ে, দিদি।

প্রতিবেশিনী।

নাটোরের মহারাজার ওখানে একটা কাজ খালি হয়েছে। আমার ছেলের জন্যে যতীনের কাছ থেকে একখানা চিঠি লিখিয়ে--

শম্ভু।

দিদি, সে কোনোমতেই হবে না। মাসি জানতে পারলে রক্ষে থাকবে না।

প্রতিবেশিনী।

জানবে কী কঞ্চরে। আমি ফস্‌ করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে--

শম্ভু।

মাপ করো দিদি, সে কোনোমতেই হবে না।

প্রতিবেশিনী।

হবে-না! তোমার মাসি মনে করেন, আমাদের ছোঁয়াচ লাগলে তাঁর বোনপো বাঁচবে না। এদিকে নিজের কথাটা ভেবে দেখেন না। স্বামীটিকে খেয়েছেন, একটিমাত্র মেয়ে সেও গেছে, বাপমা কাউকেই রাখলে না। এইবার বাকি আছে ঐ যতীন। ওকে শেষ করে তবে উনি নড়বেন। নইলে ওঁর আর মরণ নেই। আমি বলে রাখলুম শম্ভু, দেখে নিস্‌-- মাসিতে যখন ওকে পেয়েছে, যতীনের আশা নেই।

শম্ভু।

ঐ আমাকে ডাকছেন। তুমি এখন যাও।

প্রতিবেশিনী।

ভয় নেই, আমি চললুম।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

ঘরে শম্ভুর প্রবেশ

ঘরে শম্ভুর প্রবেশ

যতীন।

(পায়ের শব্দে চমকাইয়া) মণি!

শম্ভু।

কর্তাবাবু, আমি শম্ভু। আমাকে ডাকছিলেন?

যতীন।

একবার তোর বউঠাকরুনকে ডেকে দে।

শম্ভু।

কাকে।

যতীন।

বউঠাকরুনকে।

শম্ভু।

তিনি তো এখনো ফেরেন নি।

যতীন।

কোথায় গেছেন।

শম্ভু।

সীতারামপুরে।

যতীন।

আজ গেছেন?

শম্ভু।

না, আজ তিন দিন হল।

যতীন।

তুই কে? আমি কি চোখে ঠিক দেখছি।

শম্ভু।

আমি শম্ভু।

যতীন।

ঠিক করে বল্‌ তো, আমার তো কিছু ভুল হচ্ছে না?

শম্ভু।

না, বাবু।

যতীন।

কোন্‌ ঘরে আছি আমি? এই কি সীতারামপুর।

শম্ভু।

না, কলকাতায় এ তো আপনার শোবার ঘর।

যতীন।

মিথ্যে নয়? এ সমস্তই মিথ্যে নয়?

শম্ভু।

আমি মাসিমাকে ডেকে দিই।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

মাসির প্রবেশ

মাসির প্রবেশ

যতীন।

আমি যে মরে যাই নি, তা কী করে জানব, মাসি। হয়তো সবই উলটে গেছে।

মাসি।

ও কী বলছিস, যতীন।

যতীন।

তুমি তো আমার মাসি?

মাসি।

না তো কী, যতীন।

যতীন।

হিমিকে ডেকে দাও-না, সে আমার পাশে বসুক। সে যেন থাকে আমার কাছে। এখনই যেন কোথাও না যায়।

মাসি।

আয় তো হিমি, এখানে বোস্‌ তো!

যতীন।

ঐ বাঁশিটা থামিয়ে দাও-না। ওটা কি গৃহপ্রবেশের জন্যে আনিয়েছ। ওর আর দরকার নেই।

মাসি।

পাশের বাড়িতে বিয়ে, ও বাঁশি সেইখানে বাজছে।

যতীন।

বিয়ের বাঁশি? ওর মধ্যে অত কান্না কেন। বেহাগ বুঝি? তোমাকে কি আমার স্বপ্নের কথা বলেছি, মাসি।

মাসি।

কোন্‌ স্বপ্ন।

যতীন।

মণি যেন আমার ঘরে আসবার জন্যে দরজা ঠেলছিল। কোনোমতেই দরজা এতটুকুর বেশি ফাঁক হল না। সে বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। কিছুতেই ঢুকতে পারলে না। অনেক করে ডাকলুম, তার আর গৃহপ্রবেশ হল না। হল না, হল না, হল না।--

[ মাসি নিরুত্তর

বুঝেছি মাসি, বুঝেছি, আমি দেউলে। একেবারে দেউলে। সব দিকে। এ বাড়িটাও নেই-- সব বিক্রি হয়ে গেছে, কেবল নিজেকে ভোলাচ্ছিলুম।

মাসি।

না যতীন, না, শপথ করে বলছি তোর বাড়ি ঠিক আছে-- অখিল এসেছে, যদি বলিস তাকে ডেকে দিই।

যতীন।

বাড়িটা তবে আছে? সে তো অপেক্ষা করতে পারবে, আমার মতো সে তো ছায়া নয়। বৎসরের পর বৎসর সে দরজা খুলে থাক্‌-না দাঁড়িয়ে। কী বল, মাসি।

মাসি।

থাকবে বৈকি যতীন, তোর ভালোবাসায় ভরা হয়ে থাকবে।

যতীন।

ভাই হিমি, তুই থাকবি আমার ঘরটিতে। একদিন হয়তো সময় হবে, ঘরে প্রবেশ করবে। সেদিন যে-লোকেই থাকি, আমি জানতে পারব। হিমি, হিমি!

হিমি।

কী, দাদা।

যতীন।

তোর উপর ভার রইল, বোন। মনে আছে, কোন্‌ গানটা গাবি?

হিমি।

আছে-- অগ্নিশিখা, এসো এসো।

যতীন।

লক্ষ্মী বোন আমার, কারো উপর রাগ করিস নে। সবাইকে ক্ষমা করিস। আর আমাকে যখন মনে করবি তখন মনে করিস, "আমাকে দাদা চিরদিন ভালোবাসত, আজও ভালোবাসে।' জান মাসি, আমার এই বাড়িতেই হিমির বিয়ে হবে? আমাদের সেই পুরোনো দালানে, যেখানে আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল। সে দালানে আমি একটুও হাত দিই নি।

মাসি।

তাই হবে, বাবা।

যতীন।

মাসি, আর-জন্মে তুমি আমার মেয়ে হয়ে জন্মাবে, তোমাকে বুকে করে মানুষ করব।

মাসি।

বলিস কী, যতীন। আবার মেয়ে হয়ে জন্মাব? না-হয় তোরই কোলে ছেলে হয়েই জন্ম হবে। সেই কামনাই কর্‌-না।

যতীন।

না, ছেলে না-- ছিঃ! ছোটোবেলায় যেমন ছিলে তেমনি অপরূপ সুন্দরী হয়ে তুমি আমার ঘরে আসবে। আমি তোমাকে সাজাব।

মাসি।

আর বকিস নে, একটু ঘুমো।

যতীন।

তোমার নাম দেব লক্ষ্মীরানী--

মাসি।

ও তো একেলে নাম হল না।

যতীন।

না, একেলে না। তুমি চিরদিন আমার সাবেককেলে। সেই তোমার সুধায়-ভরা সাবেককাল নিয়েই তুমি আমার ঘরে এসো।

মাসি।

তোর ঘরে কন্যাদায়ের দুঃখ নিয়ে আসব, এ কামনা আমি তো করি-নে।

যতীন।

তুমি আমাকে দুর্বল মনে কর, মাসি? দুঃখ থেকে বাঁচাতে চাও?

মাসি।

বাছা, আমার যে মেয়েমানুষের মন, আমিই দুর্বল। তাই তোকে বড়ো ভয়ে ভয়ে সকল দুঃখ থেকে চিরদিন বাঁচাতে চেয়েছি। কিন্তু আমার সাধ্য কী আছে। কিছুই করতে পারি নি।

যতীন।

মাসি, একটা কথা গর্ব করে বলতে পারি। যা পাই নি তা নিয়ে কোনোদিন কাড়াকাড়ি করি নি। সমস্ত জীবন হাতজোড় করে অপেক্ষাই করলুম। মিথ্যাকে চাই নি বলেই এত সবুর করতে হল। সত্য হয়তো এবার দয়া করবেন।-- ও কে ও, মাসি ও কে।

মাসি।

কই, কেউ তো না, যতীন।

যতীন।

তুমি একবার ও-ঘরটা দেখে এসোগে, আমি যেন--

মাসি।

না বাছা, কাউকে দেখছি নে।

যতীন।

আমি কিন্তু স্পষ্ট যেন--

মাসি।

কিচ্ছু না, যতীন।

ডাক্তারের প্রবেশ

ডাক্তারের প্রবেশ

যতীন।

ও কে ও। কোথা থেকে আসছ? কিছু খবর আছে?

মাসি।

উনি ডাক্তার।

ডাক্তার।

আপনি ওঁর কাছে থাকবেন না-- আপনার সঙ্গে বড়ো বেশি কথা কন--

যতীন।

না, মাসি, যেতে পাবে না।

মাসি।

আচ্ছা, বাছা, আমি ঐ কোণটাতে গিয়ে বসছি।

যতীন।

না, না, আমার পাশে বোসো, আমার হাত ধ'রে। ভগবান তোমার হাত থেকেই আমাকে নিজের হাতে নেবেন।

ডাক্তার।

আচ্ছা বেশ। কিন্তু কথা কবেন না। আর, সেই ওষুধটা খাবার সময় হল।

যতীন।

সময় হল? আবার ভোলাতে এসেছ? সময় পার হয়ে গেছে। মিথ্যে সান্ত্বনায় আমার দরকার নেই। বিদায় করে দাও, সব বিদায় করে দাও। মাসি, এখন আমার তুমি আছ-- কোনো মিথ্যাকেই চাই নে। আয় ভাই হিমি, আমার পাশে বোস্‌।

ডাক্তার।

এতটা উত্তেজনা ভালো হচ্ছে না।

যতীন।

তবে আমাকে আর উত্তেজিত কোরো না।--

[ ডাক্তারের প্রস্থান

ডাক্তার গেছে, এইবার আমার বিছানায় উঠে বোসো, তোমার কোলে মাথা দিয়ে শুই।

মাসি।

শোও বাবা, একটু ঘুমোও।

যতীন।

ঘুমোতে বোলো না, এখনো আমার আর-একটু জেগে থাকবার দরকার আছে। শুনতে পাচ্ছ না? আসছে। এখনই আসবে। চোখের উপর কী রকম সব ঘোর হয়ে আসছে। গোধূলিলগ্ন, গোধূলিলগ্ন আমার। বাসরঘরের দরজা খুলবে। হিমি ততক্ষণ ঐ গানটা-- জীবনমরণের সীমানা পারায়ে।

হিমির গান

হিমির গান

জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে

বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে।

এ মোর হৃদয়ের বিজন আকাশে

তোমার মহাসন আলোতে ঢাকা সে,

গভীর কী আশায় নিবিড় পুলকে

তাহার পানে চাই দুবাহু বাড়ায়ে।

নীরব নিশি তব চরণ নিছায়ে

আঁধার-কেশভার দিয়েছে বিছায়ে

আজি এ কোন্‌ গান নিখিল প্লাবিয়া

তোমার বীণা হতে আসিল নাবিয়া।

ভুবন মিলে যায় সুরের রণনে--

গানের বেদনায় যাই যে হারায়ে।

মণির প্রবেশ

মণির প্রবেশ

মাসি।

বাবা, যতীন, একটু চেয়ে দেখ্‌। ঐ যে এসেছে।

যতীন।

কে। স্বপ্ন?

মাসি।

স্বপ্ন নয়। বাবা, মণি। ঐ যে তোমার শ্বশুর।

যতীন।

(মণির দিকে চাহিয়া) তুমি কে।

মাসি।

চিনতে পারছ না? ঐ তো তোমার মণি।

যতীন।

দরজাটা কি সব খুলে গেছে।

মাসি।

সব খুলেছে।

যতীন।

কিন্তু পায়ের উপর ও শালটা নয়, ও শালটা নয়। সরিয়ে দাও, সরিয়ে দাও।

মাসি।

শাল নয়, যতীন। বউ তোর পায়ের উপর পড়েছে। ওর মাথায় হাত রেখে একটু আশীর্বাদ কর্‌।
1 | 2