পাশের ঘরে অখিলের প্রবেশ
[তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছিয়া হিমি উঠিয়া দাঁড়াইল]
[তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছিয়া হিমি উঠিয়া দাঁড়াইল]
হিমি।
মাসিকে ডেকে দিই।
অখিল।
দরকার নেই। তেমন জরুরি কিছু নয়।
হিমি।
দাদার ঘরে কি যাবেন।
অখিল।
না, এইখান থেকেই খবর নিয়ে যাব। যতীন কেমন আছে।
হিমি।
ডাক্তার বলেন, আজ অবস্থা ভালো নয়।
অখিল।
কদিন থেকে তোমরা দিনরাত্রিই খাটছ। আমি এলুম তোমাদের একটু জিরোতে দেবার জন্যে। বোধ হয় রোগীর সেবা আমিও কিছু কিছু--
হিমি।
না, সে হতেই পারে না। আমি কিচ্ছু শ্রান্ত হই নি।
অখিল।
আচ্ছা, না-হয় আমি তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে কাজ করি।
হিমি।
এ-সব কাজ--
অখিল।
জানি, ওকালতির চেয়ে অনেক বেশি শক্ত।
হিমি।
না, আমি তা বলছি নে।
অখিল।
না, সত্যি কথা। আমাকে যদি বার্লি তৈরি করতে হয়, আমি হয়তো ঘরে আগুন লাগিয়ে দেব।
হিমি।
কী বলছেন আপনি।
অখিল।
একটুও বাড়িয়ে বলছি নে। ঘরে আগুন লাগানো আমাদের অভ্যেস। বুঝতে পারছ না?-- দেখো-না কেন, তুমি তো যতীনের জন্যে বার্লি তৈরি করছ, আমি হয়তো এমন কিছু তৈরি করে বসে আছি যেটা রোগীর পথ্য নয়, অরোগীর পক্ষেও গুরুপাক। তুমি বোসো, দুটো কথা তোমার সঙ্গে কয়ে নিই।
হিমি।
এখন কিন্তু গল্প করবার মতো--
অখিল।
রামো! গল্প করতে পারলে আমাদের ব্যাবসা ছেড়ে দিতুম, দ্বিতীয় বঙ্কিম চাটুজ্জে হয়ে উঠতুম। হাসছ কী। আমাদের অনেক কথাই বানাতে হয়, একটুও ভালো লাগে না-- গল্প বানাতে পারলে এ ব্যাবসা ছেড়ে দিতুম। তুমি বোধ হয় গল্প লেখা শুরু করেছ?
হিমি।
না।
অখিল।
নাটক তৈরি--
হিমি।
না, আমার ও-সব আসে না।
অখিল।
কী করে জানলে।
হিমি।
ভাষায় কুলোয় না।
অখিল।
নাটক তৈরি করতে ভাষার দরকার হয় না। খাতাপত্র কিছুই চাই নে। হয়তো এখনই তোমার নাটক শুরু হয়েছে-বা, কে বলতে পারে।
হিমি।
আমি যাই, মাসিকে ডেকে দিই।
অখিল।
না, দরকার হবে না। আমি বাজে কথা বন্ধ করলুম, কাজের কথাই পাড়ব। ভেবেছিলুম যতীনকেই বলব। কিন্তু তার শরীর যে-রকম এখন--
হিমি।
তাঁর ব্যাবসার কোনো গুজব আমার কানে উঠেছে কি না এ কথা প্রায় আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি হয়তো--
অখিল।
আমি জানি, ব্যাবসা গেছে তলিয়ে--
হিমি।
পায়ে পড়ি, তাঁকে এ খবর দেবেন না। আর যাই হোক, তাঁর এই বাড়িটা তো--
অখিল।
যতীন বাড়ির কথা বলে নাকি।
হিমি।
কেবল ঐ কথাই বলছেন। একদিন ধুম ক'রে গৃহপ্রবেশ হবে, তারই প্ল্যান--
অখিল।
গৃহপ্রবেশের আয়োজন তো হয়েছে--
হিমি।
আপনি কী করে জানলেন।
অখিল।
আমার আপিস থেকেই হয়েছে-- পেয়াদারা বেশভূষা ক'রে প্রায় তৈরি--
হিমি।
দেখুন অখিলবাবু, এ হাসির কথা নয়--
অখিল।
সে কি আর আমি জানি নে। তোমার কাছে লুকিয়ে কী হবে। এ বাড়িটা দেনায়--
হিমি।
না না না-- সে হতেই পারবে না-- অখিলবাবু, দয়া করবেন--
অখিল।
কিন্তু এত ভাবছ কেন? তুমি তো সব জানই। তোমাদের দাদা তো আর বেশিদিন--
হিমি।
জানি জানি, দাদা আর থাকবেন না, সেও সহ্য হবে, কিন্তু তাঁর এই বাড়িটিও যদি যায় তা হলে বুক ফেটে মরে যাব। এ যে তাঁর প্রাণের চেয়ে--
অখিল।
দেখো, তুমি সাহিত্যে গণিতে লজিকে ক্লাসে পুরো মার্কা পেয়ে থাক, কিন্তু সংসারজ্ঞানে থার্ড্ ক্লাসেও পাস করতে পারবে না। বিষয়কর্মে হৃদয় ব'লে কোনো পদার্থ নেই, ওর নিয়ম--
হিমি।
আমি জানি নে। আপনার পায়ে পড়ি, এ বাড়ি আপনাকে বাঁচাতে হবে। আপনার আপিসের--
অখিল।
পেয়াদাগুলোকে সাজাতে হবে বাজনদার করে, হাতে দিতে হবে বাঁশি। ল কলেজে লয়তত্ত্বের সব অধ্যায় শিখেছি, কেবল তানলয়ের পালাটা প্র৻াক্টিস হয় নি। এটা হয়তো বা তোমার কাছ থেকেই--
মাসির প্রবেশ
মাসির প্রবেশ
মাসি।
অখিল, কী হচ্ছে। হিমি কাঁদছে কেন।
অখিল।
গৃহপ্রবেশের প্ল্যানে একটু খটকা বেধেছে তাই নিয়ে--
মাসি।
তা ওর সঙ্গে এ-সব কথা কেন।
অখিল।
ওর দাদা যে ওরই উপরে গৃহপ্রবেশের ভার দিয়েছে, শুনছি কাজটাতে কোনো বাধা না হয়, এইজন্যে এত লোককে ছেড়ে আমাকেই ধরেছে। তা তোমরা যদি সকলেই মনে কর, তা হলে চাই-কি গৃহপ্রবেশের কাজে আমিও কোমর বেঁধে লাগতে পারি। কথাটা বুঝেছ, কাকি?
মাসি।
বুঝেছি। শুধু কোমর বাঁধা নয়, বাঁধন আরও পাকা করতে চাও। এখন সে পরামর্শ করবার সময় নয়। আপাতত যতীনকে তুমি আশ্বাস দিয়ো যে তার বাড়িতে কারো হাত পড়বে না।
অখিল।
বেশ তো, বললেই হবে পাটের বাজার চড়েছে। এখন এঁকে চোখের জলটা মুছতে বলবেন--
ডাক্তারের প্রবেশ
ডাক্তারের প্রবেশ
ডাক্তার।
উকিল যে! তবেই হয়েছে।
অখিল।
দেখুন, শনি বড়ো না কলি বড়ো, তা নিয়ে তর্ক করে লাভ কী। বাংলাদেশে আপনাদের হাত পার হয়েও যে-কটি লোক টিঁকে থাকে, তাদেরই সামান্য শাঁসটুকু নিয়েই আমাদের কারবার--
ডাক্তার।
এ ঘরে সে কারবার চালাবার আর বড়ো সময় নেই, দেখে এসেছি।
অখিল।
ভয় দেখাবেন না মশায়, মৃত্যুতেই আপনাদের ব্যাবসা খতম, আমাদেরটা ভালো ক'রে জমে তার পর থেকে। না না, থাক্ থাক্, ও-সব কথা থাক্-- কাকি, এই বলে যাচ্ছি, গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানের সমস্ত ভার নিতে রাজি আছি-- তার সঙ্গে সঙ্গে উপরি আরো-কিছু ভারও। বাইরের ঘরে থাকব, যখন দরকার হয় ডেকে পাঠিয়ো।
[ প্রস্থান
[ প্রস্থান
ডাক্তার।
এখনো বউমা এল না। আপনিও তো অনেকক্ষণ ওর ঘরে যান নি।
মাসি।
মণির কথা জিজ্ঞাসা করলে কী জবাব দেব ভেবে পাচ্ছি নে। আর তো আমি কথা বানিয়ে উঠতে পারি নে-- নিজের উপর ধিক্কার জন্মে গেল। ও একটু ঘুমিয়ে পড়লে তার পরে ঘরে যাব।
ডাক্তার।
আমি বাইরে অপেক্ষা করব। রুগী কেমন থাকে ঘণ্টাখানেক পরে খবর দেবেন। ইতিমধ্যে উকিলকে ঠেকিয়ে রাখতে হবে, ওদের মুখ দেখলে সহজ অবস্থাতেই নাড়ী ছাড়ব ছাড়ব করে।
[প্রস্থান
[প্রস্থান