রাজপুত্র ও সদাগরপুত্র

রাজপুত্র ও সদাগরপুত্র

রাজপুত্র।

এক ডাঙা থেকে দিলেম পাড়ি, তরী ডুবল মাঝ সমুদ্রে, ভেসে উঠলেম আর-এক ডাঙায়। এতদিন পরে মনে হচ্ছে, জীবনে নতুন পর্ব শুরু হল।

সদাগর।

রাজপুত্র, তুমি তো কেবলই নতুন নতুন করে অস্থির হলে। আমি ভয় করি ঐ নতুনকেই। যাই বল, বন্ধু, পুরোনোটা আরামের।

রাজপুত্র।

ব্যাঙের আরাম এঁদো কুয়োর মধ্যে। এটা বুঝলে না, উঠে এসেছি মরণের তলা থেকে। যম আমাদের ললাটে নতুন জীবনের তিলক পরিয়ে দিলেন।

সদাগর।

রাজতিলক তোমার ললাটে তো নিয়েই এসেছ জন্মমুহূর্তে।

রাজপুত্র।

সে তো অদৃষ্টের ভিক্ষেদানের ছাপ। যমরাজ মহাসমুদ্রের জলে সেটা কপাল থেকে মুছে দিয়ে হুকুম করেছেন, নতুন রাজ্য নতুন শক্তিতে জয় করে নিতে হবে, নতুন দেশে।--

গান

এলেম নতুন দেশ

তলায় গেল ভগ্ন তরী, কূলে এলেম ভেসে।

অচিন মনের ভাষা

শোনাবে অপূর্ব কোন্‌ আশা,

বোনাবে রঙিন সুতোয় দুঃখসুখের জাল,

বাজবে প্রাণে নতুন গানের তাল,

নতুন বেদনায় ফিরব কেঁদে হেসে।

নাম-না-জানা প্রিয়া

নাম-না-জানা ফুলের মালা নিয়া

হিয়ায় দেবে হিয়া।

যৌবনেরি নবোচ্ছ্বাসে

ফাগুনমাসে

বাজবে নূপুর ঘাসে ঘাসে,

মাতবে দখিনবায়

মঞ্জরিত লবঙ্গলতায়

চঞ্চলিত এলোকেশে॥

সদাগর।

রাজপুত্র, তোমার গানের সুরে কথাটা শোনাচ্ছে ভালো। কিন্তু, জিজ্ঞাসা করি, এ দেশে যৌবনের নবীন রূপ দেখলে কোথায়। চারি দিকটা তো একবার ঘুরে এসেছি। দেখে মনে হল, যেন ছুতোরের তৈরি কাঠের কুঞ্জবন। দেখলুম, ওরা চৌকো চৌকো কেঠো চালে চলেছে, বুকে পিঠে চ্যাপটা, পা ফেলছে খিট্‌খুট্‌ খিট্‌খুট্‌ শব্দে, বোধ করি চৌকুনি নূপুর পরেছে পায়ে, তৈরি সেটা তেঁতুল কাঠে। এই মরা দেশকে কি বলে নতুন দেশ।

রাজপুত্র।

এর থেকেই বুঝবে, জিনিসটা সত্যি নয়, এটা বানানো, এটা উপর থেকে চাপানো, এদের দেশের পণ্ডিতদের হাতে গড়া খোলস। আমরা এসেছি কী করতে--খসিয়ে দেব। ভিতর থেকে প্রাণের কাঁচা রূপ যখন বেরিয়ে পড়বে, আশ্চর্য করে দেবে।

সদাগর।

আমরা সদাগর মানুষ, যা পষ্ট দেখি তার থেকেই দর যাচাই করি। আর, যা দেখতে পাও না তারই উপর তোমাদের বিশ্বাস। আচ্ছা, দেখা যাক, ছাইয়ের মধ্যে থেকে আগুন বেরোয় কি না। আমার তো মনে হয়, ফুঁ দিতে দিতে দম ফুরিয়ে যাবে। ঐ দেখো-না, এই দিকেই আসছে--এ যেন মরা দেহে ভূতের নৃত্য।

রাজপুত্র।

একটু সরে দাঁড়ানো যাক। দেখি-না কাণ্ডটা কী।

তাসের দলের প্রবেশ

তাসের কাওয়াজ

তাসের দলের প্রবেশ

তাসের কাওয়াজ

গান

গান

তোলন নামন

পিছন সামন,

বাঁয়ে ডাইনে

চাই নে চাই নে,

বোসন ওঠন,

ছড়ান গুটন,

উলটো-পালটা

ঘূর্ণি চালটা--

বাস্‌ বাস্‌ বাস্‌।

সদাগর।

দেখছ ব্যাপারটা! লাল উর্দি, কালো উর্দি, উঠছে পড়ছে, শুচ্ছে বসছে, একেবারে অকারণে--ভারি অদ্ভুত। হা হা হা হা।

ছক্কা।

এ কী ব্যাপার! হাসি!

পঞ্জা।

লজ্জা নেই তোমাদের! হাসি!

ছক্কা।

নিয়ম মান না তোমরা! হাসি!

রাজপুত্র।

হাসির তো একটা অর্থ আছে। কিন্তু, তোমরা যা করেছিলে তার অর্থ নেই যে।

ছক্কা।

অর্থ? অর্থের কী দরকার। চাই নিয়ম। এটা বুঝতে পার না? পাগল নাকি তোমরা!

রাজপুত্র।

খাঁটি পাগল তো চেনা সহজ নয়। চিনলে কী করে।

পঞ্জা।

চালচলন দেখে।

রাজপুত্র।

কী রকম দেখলে।

ছক্কা।

দেখলেম, কেবল চলনটাই আছে তোমাদের, চালটা নেই।

সদাগর।

আর, তোমাদের বুঝি চালটাই আছে, চলনটা নেই?

পঞ্জা।

জান না, চালটা অতি প্রাচীন, চলনটাই আধুনিক, অপোগণ্ড, অর্বাচীন, অজাতশ্মশ্রু।

ছক্কা।

গুরুমশায়ের হাতে মানুষ হও নি। কেউ বুঝিয়ে দেয় নি, রাস্তায় ঘাটে খানা আছে, ডোবা আছে, কাঁটা আছে, খোঁচা আছে--চলন জিনিসটার আপদ বিস্তর।

রাজপুত্র।

এ দেশটা তো গুরুমশায়েরই দেশ। শরণ নেব তাঁদের।

ছক্কা।

এবার তোমাদের পরিচয়টা?

রাজপুত্র।

আমরা বিদেশী।

পঞ্জা।

বাস্‌। আর, বলতে হবে না। তার মানে, তোমাদের জাত নেই, কুল নেই, গোত্র নেই, গাঁই নেই, জ্ঞাত নেই, গুষ্টি নেই, শ্রেণী নেই, পঙ্‌ক্তি নেই।

রাজপুত্র।

কিছু নেই, কিছু নেই--সব বাদ দিয়ে এই যা আছে, দেখছই তো। এখন তোমাদের পরিচয়টা?

ছক্কা।

আমরা ভুবনবিখ্যাত তাসবংশীয়। আমি ছক্কা শর্মণ।

পঞ্জা।

আমি পঞ্জা বর্মণ।

রাজপুত্র।

ঐ যারা সংকোচে দূরে দাঁড়িয়ে?

ছক্কা।

কালো-হানো, ঐ তিরি ঘোষ।

পঞ্জা।

আর, রাঙা-মতো এই দুরি দাস।

সদাগর।

তোমাদের উৎপত্তি কোথা থেকে।

ছক্কা।

ব্রহ্মা হয়রান হয়ে পড়লেন সৃষ্টির কাজে। তখন বিকেল বেলাটায় প্রথম যে হাই তুললেন, পবিত্র সেই হাই থেকে আমাদের উদ্‌ভব।

পঞ্জা।

এই কারণে কোনো কোনো ম্লেচ্ছভাষায় আমাদের তাসবংশীয় না ব'লে হাইবংশীয় বলে।

সদাগর।

আশ্চর্য।

ছক্কা।

শুভ গোধূলিলগ্নে পিতামহ চার মুখে একসঙ্গে তুললেন চার হাই।

সদাগর।

বাস্‌ রে। ফল হল কী।

ছক্কা।

বেরিয়ে পড়ল ফস্‌ ফস্‌ ক'রে ইস্কাবন, রুইতন, হরতন, চিঁড়েতন। এঁরা সকলেই প্রণম্য। (প্রণাম)

রাজপুত্র।

সকলেই কুলীন?

ছক্কা।

কুলীন বৈকি। মুখ্য কুলীন। মুখ থেকে উৎপত্তি।

পঞ্জা।

তাসবংশের আদিকবি ভগবান তাসরঙ্গনিধি দিনের চার প্রহর ঘুমিয়ে স্বপ্নের ঘোরে প্রথম যে ছন্দ বানালেন সেই ছন্দের মাত্রা গুনে গুনে আমাদের সাড়ে-সাঁইত্রিশ রকমের পদ্ধতির উদ্‌ভব।

রাজপুত্র।

অন্তত তার একটাও তো জানা চাই।

পঞ্জা।

আচ্ছা, তা হলে মুখ ফেরাও।

রাজপুত্র।

কেন।

পঞ্জা।

নিয়ম। ভাই ছক্কা, ঠুং মন্ত্র প'ড়ে ওদের কানে একটা ফুঁ দিয়ে দাও।

রাজপুত্র।

কেন।

পঞ্জা।

নিয়ম।

তাসের দলের গান

হা-হা-আ-আই।

হাতে কাজ নাই।

দিন যায় দিন যায়।

আয় আয় আয় আয়।

হাতে কাজ নাই॥

রাজপুত্র।

আর সহ্য করতে পারছি নে, মুখ ফেরাতে হল।

পঞ্জা।

এঃ! ভেঙে দিলে মন্ত্রটা! অশুচি করে দিলে!

রাজপুত্র।

অশুচি?

পঞ্জা।

অশুচি নয় তো কী। মন্ত্রের মাঝখানটায় বিদেশীর দৃষ্টি পড়ল।

রাজপুত্র।

এখন উপায়?

ছক্কা।

বাদুড়ে-খাওয়া গাবের আঁটি পুড়িয়ে তিন দিন চোখে কাজল পরতে হবে, তবেই স্বর্গে পিতামহদের উপোস ভাঙবে।

রাজপুত্র।

বিপদ ঘটিয়েছি তো। তোমাদের দেশে খুব সাবধানে চলতে হবে।

ছক্কা।

একেবারে না চললেই ভালো হয়, শুচি থাকতে পারবে।

রাজপুত্র।

শুচি থাকলে কী হয়।

পঞ্জা।

কী আর হবে, শুচি থাকলে শুচি হয়। বুঝতে পারছ না?

রাজপুত্র।

আমাদের পক্ষে বোঝা অসম্ভব। একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, ঐ পাড়ির উপরে কী করছিলে দল বেঁধে।

ছক্কা।

যুদ্ধ।

রাজপুত্র।

তাকে বলে যুদ্ধ?

পঞ্জা।

নিশ্চয়! অতি বিশুদ্ধ নিয়মে। তাসবংশোচিত আচার-অনুসারে।

গান

আমরা চিত্র, অতি বিচিত্র,

অতি বিশুদ্ধ, অতি পবিত্র।

সদাগর।

তা হোক। যুদ্ধে একটু রাগারাগি না হলে রস থাকে না।

ছক্কা।

আমাদের রাগ রঙে।

আমাদের যুদ্ধ--

নহে কেহ ক্রুদ্ধ,

ওই দেখো গোলাম

অতিশয় মোলাম।

সদাগর।

তা হোক্‌-না, তবু কামান-বন্দুকটা যুদ্ধক্ষেত্রে মানায় ভালো।

পঞ্জা।

নাহি কোনো অস্ত্র,

খাকি-রাঙা বস্ত্র।

নাহি লোভ,

নাহি ক্ষোভ,

নাহি লাফ,

নাহি ঝাঁপ।

রাজপুত্র।

নাই রইল, তবু একটা নালিশ থাকা চাই তো। তাই নিয়েই তো দুই পক্ষে লড়াই।

ছক্কা।।

যথারীতি জানি

সেইমতে মানি,

কে তোমার শত্রু, কে তোমার মিত্র,

কে তোমার টক্কা, কে তোমার ফক্কা॥

পঞ্জা।

ওহে বিদেশী, শাস্ত্রমতে তোমাদেরও তো একটা উৎপত্তি ঘটেছিল?

সদাগর।

নিশ্চিত। পিতামহ ব্রহ্মা সৃষ্টির গোড়াতেই সূর্যকে সেই শানে চড়িয়েছেন অমনি তাঁর নাকের মধ্যে ঢুকে পড়ল একটা আগুনের স্ফুলিঙ্গ। তিনি কামানের মতো আওয়াজ ক'রে হেঁচে ফেললেন--সেই বিশ্ব-কাঁপানি হাঁচি থেকেই আমাদের উৎপত্তি।

ছক্কা।

এখন বোঝা গেল! তাই এত চঞ্চল!

রাজপুত্র।

স্থির থাকতে পারি নে, ছিটকে ছিটকে পড়ি।

পঞ্জা।

সেটা তো ভালো নয়।

সদাগর।

কে বলছে ভালো। আদিযুগের সেই হাঁচির তাড়া আজও সামলাতে পারছি নে।

ছক্কা।

একটা ভালো ফল দেখতে পাচ্ছি--এই হাঁচির তাড়ায় তোমরা সকাল-সকাল এই দ্বীপ থেকে ছিটকে পড়বে, টিঁকতে পারবে না।

সদাগর।

টেঁকা শক্ত।

পঞ্জা।

তোমাদের যুদ্ধটা কী ধরনের।

সদাগর।

সেটা দুই দুই পক্ষের চার চার জোড়া হাঁচির মাপে।

ছক্কা।

হাঁচির মাপে? বাস্‌ রে, তা হলে মাথা ঠেকাঠুকি হবে তো!

সদাগর।

হাঁ, একেবারে দমাদ্দম।

ছক্কা।

তোমাদেরও আদিকবির মন্ত্র আছে তো?

সদাগর।

আছে বৈকি।

গান

হাঁচ্ছোঃ,

ভয় কী দেখাচ্ছ।

ধরি টিপে টুঁটি,

মুখে মারি মুঠি,

বলো দেখি কী আরাম পাচ্ছ॥

ছক্কা।

ওহে ভাই পঞ্জা, একেবারে অসবর্ণ। কী জাতি তোমরা।

সদাগর।

আমরা নাশক, নাসা থেকে উৎপন্ন।

পঞ্জা।

কোনো উচ্চবংশীয় জাতির অমনতরো নাম তো শুনি নি।

সদাগর।

হাইয়ের বাষ্পে তোমরা উড়ে গেছ উচ্চে, পরলোকের পারে; হাঁচির চোটে আমরা পড়েছি নীচে, এই ইহলোকের ধারে।

ছক্কা।

পিতামহের নাসিকার অসংযমবশতই তোমরা এমন অদ্ভুত।

রাজপুত্র।

এতক্ষণে ঠিক কথাটাই বেরিয়েছে তোমার মুখ থেকে, আমরা অদ্ভুত।

গান

আমরা নূতন যৌবনেরই দূত,

আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত।

আমরা বেড়া ভাঙি,

আমরা অশোকবনের রাঙা নেশায় রাঙি,

ঝঞ্ঝার বন্ধন ছিন্ন করে দিই,

আমরা বিদ্যুৎ।

আমরা করি ভুল।

অগাধ জলে ঝাঁপ দিয়ে

যুঝিয়ে পাই কূল।

যেখানে ডাক পড়ে

জীবন-মরণ-ঝড়ে

আমরা প্রস্তুত॥

ছক্কা-পঞ্জা।

(পরস্পর মুখ চেয়ে) এ চলবে না, এ চলবে না।

রাজপুত্র।

যা চলবে না তাকেই আমরা চালাই।

ছক্কা।

কিন্তু, নিয়ম!

রাজপুত্র।

বেড়ার নিয়ম ভাঙলেই পথের নিয়ম আপনিই বেরিয়ে পড়ে, নইলে এগোব কী করে।

পঞ্জা।

ওরে ভাই, কী বলে এরা। এগোবে! অম্লানমুখে ব'লে বসল, এগোব।

রাজপুত্র।

নইলে চলা কিসের জন্যে।

ছক্কা।

চলা! চলবে কেন তুমি! চলবে নিয়ম।

গান

চলো নিয়ম-মতে।

দূরে তাকিয়ো নাকো,

ঘাড় বাঁকিয়ে নাকো,

চলো সমান পথে।

রাজপুত্র।



হেরো অরণ্য ওই,

হোথা শৃঙ্খলা কই,

পাগল ঝরনাগুলো

দক্ষিণ পর্বতে।

তাসের দল।



ওদিকে চেয়ো না চেয়ো না,

যেয়ো না যেয়ো না--

চলো সমান পথে॥

পঞ্জা।

আর নয়, ঐ আসছেন রাজাসাহেব, আসছেন রানীবিবি। এইখানে আজ সভা। এই নাও ভুঁইকুমড়োর ডাল একটা ক'রে।

রাজপুত্র।

ভুঁইকুমড়োর ডাল? হা হা হা হা--কেন।

পঞ্জা।

চুপ। হেসো না, নিয়ম। বোসো ঈশান কোণে মুখ ক'রে, খবরদার বায়ুকোণে মুখ ফিরিয়ো না।

রাজপুত্র।

কেন।

ছক্কা।

নিয়ম।

রাজা রানী টেক্কা গোলাম প্রভৃতির

যথারীতি যথাভঙ্গিতে প্রবেশ

রাজা রানী টেক্কা গোলাম প্রভৃতির

যথারীতি যথাভঙ্গিতে প্রবেশ

রাজপুত্র।

ওহে ভাই, স্তবগান করে রাজাকে খুশি করে দিই। তুমি ভুঁইকুমড়োর ডালটা দোলাও।

গান

জয় জয় তাসবংশ-অবতংস,

তন্দ্রাতীরনিবাসী,

সব-অবকাশ ধ্বংস।

তাসের দল।

ভ্যাস্তা ভ্যাস্তা ভ্যাস্তা! অকালে সভা দিলে ভেঙে, বর্বর!

রাজা।

শান্ত হও, এরা কারা।

ছক্কা।

বিদেশী।

রাজা।

বিদেশী! তা হলে নিয়ম খাটবে না

একবার সকলে ঠাঁই বদল করে নাও, তা হলেই দোষ যাবে কেটে। সর্বাগ্রে তাসমহাসভার জাতীয় সংগীত।

সকলে।।

গান

চিঁড়েতন, হর্তন, ইস্কাবন--

অতি সনাতন ছন্দে

করতেছে নর্তন

চিঁড়েতন হর্তন।

কেউ বা ওঠে কেউ পড়ে,

কেউ বা একটু নাহি নড়ে,

কেউ শুয়ে শুয়ে ভুঁয়ে

করে কালকর্তন।

নাহি কহে কথা কিছু,

একটু না হাসে,

সামনে যে আসে,

চলে তারি পিছু পিছু।

বাঁধা তার পুরাতন চালটা,

নাই কোনো উলটা-পালটা,

নাই পরিবর্তন॥

রাজা।

ওহে বিদেশী।

রাজপুত্র।

কী রাজাসাহেব।

রাজা।

কে তুমি।

রাজপুত্র।

আমি সমুদ্রপারের দূত।

গোলাম।

ভেট এনেছ কী।

রাজপুত্র।

এ দেশে সব চেয়ে যা দুর্লভ, তাই এনেছি।

গোলাম।

সেটা কী শুনি।

রাজপুত্র।

উৎপাত।

ছক্কা।

শুনলে তো রাজাসাহেব, কথাটা তো শুনলে? লোকটা এগোতে চায়, বললে বিশ্বাস করবে না, লোকটা হাসে। দুদিনে এখানকার হাওয়া দেবে হালকা করে।

গোলাম।

এখানকার হাওয়া যেমন স্থির, যেমন ভারী, এমন কোনো গ্রহে নেই। ইন্দ্রের বিদ্যুৎ পর্যন্ত একে নাড়া দিতে পারে না, অন্যে পরে কা কথা।

সকলে।

(একবাক্যে) অন্যে পরে কা কথা।

গোলাম।

লঘুচিত্ত বিদেশী এই হাওয়াকে যদি হালকা করে তা হলে কী হবে।

রাজা।

সেটা চিন্তার বিষয়।

সকলে।

সেটা চিন্তার বিষয়।

গোলাম।

হালকা হাওয়াতেই ঝড় আসে। ঝড় এলেই নিয়ম যায় উড়ে। তখন আমাদের পুরুত-ঠাকুর নহলা গোস্বামী পর্যন্ত বলতে শুরু করবেন, আমরা এগোব।

পঞ্জা।

এমন-কি, ভগবান না করুন, হয়তো এখানে হাসিটা সংক্রামক হয়ে উঠবে।

রাজা।

ওহে ইস্কাবনের গোলাম।

গোলাম।

কী রাজাসাহেব।

রাজা।

তুমি তো সম্পাদক।

গোলাম।

আমি তাসদ্বীপ প্রদীপের সম্পাদক। আমি তাসদ্বীপের কৃষ্টির রক্ষক।

রাজা।

কৃষ্টি! এটা কি জিনিস। মিষ্টি শোনাচ্ছে না তো।

গোলাম।

না মহারাজ, এ মিষ্টিও নয়, স্পষ্টও নয়, কিন্তু যাকে বলে নতুন, নবতম অবদান। এই কৃষ্টি আজ বিপন্ন।

সকলে।

কৃষ্টি, কৃষ্টি, কৃষ্টি।

রাজা।

তোমার পত্রে সম্পাদকীয় স্তম্ভ আছে তো?

গোলাম।

দুটো বড়ো বড়ো স্তম্ভ।

রাজা।

সেই স্তম্ভের গর্জনে সবাইকে স্তম্ভিত করে দিতে হবে। এখানকার বায়ুকে লঘু করা সইব না।

গোলাম।

বাধ্যতামূলক আইন চাই।

রাজা।

ওটা আবার কী বললে! বাধ্যতামূলক আইন!

গোলাম।

কানমলা আইনের নব্য ভাষা। এও নবতম অবদান।

রাজা।

আচ্ছা, পরে হবে। বিদেশী, তোমার কোনো আবেদন আছে?

রাজপুত্র।

আছে, কিন্তু তোমার কাছে নয়।

রাজা।

কার কাছে।

রাজপুত্র।

এই রাজকুমারীদের কাছে।

রাজা।

আচ্ছা, বলো।

রাজপুত্র।

গান

ওগো, শান্ত পাষাণমুরতি সুন্দরী,

চঞ্চলেরে হৃদয়তলে লও বরি।

কুঞ্জবনে এসো একা,

নয়নে অশ্রু দিক দেখা,

অরুণরাগে হোক রঞ্জিত

বিকশিত বেদনার মঞ্জরী॥

রানী।

এ কী অনিয়ম, এ কী অবিচার!

পঞ্জা।

রাজাসাহেব, নির্বাসন, ওকে নির্বাসন!

রাজা।

নির্বাসন! রানীবিবি, তোমার কী মত। চুপ ক'রে রইলে যে। শুনছ আমার কথা? একটা উত্তর দাও। কী বল, নির্বাসন তো?

রানী।

না, নির্বাসন নয়।

টেক্কাকুমারীরা।

(একে একে) না, নির্বাসন নয়।

রাজা।

রানীবিবি, তোমাকে যেন কেমন-কেমন মনে হচ্ছে।

রানী।

আমার নিজেরই মনে হচ্ছে কেমন-কেমন।

গোলাম।

টেক্কাকুমারী, বিবিসুন্দরী, মনে রেখো, আমার হাতে সম্পাদকীয় স্তম্ভ।

সকলে।

কৃষ্টি, কৃষ্টি, তাসদ্বীপের কৃষ্টি। বাঁচাও সেই কৃষ্টি।

গোলাম।

জারি করো বাধ্যতামূলক আইন।

রাজা।

অর্থাৎ?

গোলাম।

কানমলা মোচড়ের আইন।

রাজা।

বুঝেছি। রানীবিবি, তোমার কী মত। বাধ্যতামূলক আইন এবার তবে চালাই?

রানী।

বাধ্যতামূলক আইন অন্দরমহলে আমরাও চালিয়ে থাকি--দেখব, কে দেয় কাকে নির্বাসন।

টেক্কাকুমারীরা।

(সকলে) আমরা চালাব অবাধ্যতামূলক বে-আইন।

গোলাম।

এ কী হল। হায় কৃষ্টি, হায় কৃষ্টি, হায় কৃষ্টি।

রাজা।

সভা ভেঙে দিলুম। এখনি সবাই চলে এসো। আর এখানে থাকা নিরাপদ নয়।

[তাসের দলের প্রস্থান

[তাসের দলের প্রস্থান

সদাগর।

ভাই সাঙাত, এখানে তো আর সহ্য হচ্ছে না। এরা যে বিধাতার ব্যঙ্গ। এদের মধ্যে প'ড়ে আমরা সুদ্ধ মাটি হয়ে যাব।

রাজপুত্র।

ভিতরে ভিতরে কী ঘটছে , সেটা কি তোমার চোখে পড়ে না। পুতুলের মধ্যে প্রথম প্রাণের সঞ্চার কি অনুভব করছ না। আমি তো শেষ পর্যন্ত না দেখে যাচ্ছি নে।

সদাগর।

কিন্তু, এ যে জীবন্মৃতের খাঁচা, নিয়মের জারকরসে জীর্ণ এদের মন।

রাজপুত্র।

ঐ দিকে চোখ মেলে দেখো দেখি।

সদাগর।

তাই তো, বন্ধু, লেগেছে সমুদ্রপারের মন্ত্র। ইস্কাবনের নহলা গাছের তলায় পা ছড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে, দেখছি এখানকার নিয়ম গেল উড়ে।

রাজপুত্র।

চিঁড়েতনীর পায়ের শব্দ শুনছে আকাশ থেকে। এ সময়ে বোধ হয় আমাদের সঙ্গটা ওর পছন্দ হবে না। চলো, আমরা সরে যাই।

[ প্রস্থান

[ প্রস্থান

১৪। ১। ৩৯ শান্তিনিকেতন
1 | 2 | 3 | 4 | 5